মানুষ স্বভাবগত ভাবেই রহস্য প্রিয়। রহস্য প্রিয় মানুষেরা রহস্যের খোঁজে বের হয়ে যুগে যুগে পৃথিবীর জন্য অনেক কিছু করেছেন তাই রহস্যপ্রিয়তাকে মানুষের স্বভাবগত দূর্বলতা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। কিন্তু এই রহস্যপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পৃথিবীতে অনেক ধরনের বাণিজ্য হয়েছে। বারমুডাও কি সেরকম একটি পণ্য? সেটাই খোঁজার চেষ্টা করবো...
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল যা শয়তানের ত্রিভুজ নামেও পরিচিত এলাকাটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ ত্রিভুজাকার অঞ্চল যেখান বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রচারিত আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভৌগলিক অবস্থান নির্দিষ্ট নয়। কেউ মনে করেন এর আকার ট্রাপিজয়েডের মত, যা ছড়িয়ে আছে স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা, বাহামা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপূঞ্জ
এবং ইশোর (Azores) পূর্বদিকের আটলান্টিক অঞ্চল জুড়ে। আবার কেউ কেউ এগুলোর সাথে মেক্সিকোর উপসাগরকেও যুক্ত করেন। তবে লিখিত বর্ণনায় যে সকল অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে বুঝা যায় ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, সান হোয়ান (San Juan), পর্তু রিকো, মধ্য আটলান্টিকে বারমুডার দ্বীপপূঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডা স্ট্রেইটস এর দক্ষিণ সীমানা জুড়ে এটি বিস্তৃত। বিভিন্ন লেখক লেখায় বারমুডার যে বিচিত্র-ম্যাপ পাওয়া যায় তা নিন্মরুপ-
bermuda triangle area
ছবি সূত্র: উইকিপিডিয়া
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিষয়ে বিভিন্ন লেখক রেফারেন্স হিসেবে সর্বপ্রথম ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। কলম্বাস লিখেছিলেন যে তাঁর জাহাজের নবিকেরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন।
১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর সর্বপ্রথম এ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে খবরের কাগজে লিখেন ই. ভি. ডব্লিউ. জোন্স( E.V.W. Jones)। এর দুই বছর পরেই এই বিষয়ে ফেইট (Fate)ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড( George X. Sand) "Sea Mystery At Our Back Door" শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন ( ইউ এস নেভী-র পাঁচটি ‘টি বি এম অ্যাভেন্জার’ বিমানের একটি দল, যা প্রশিক্ষণ মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়) এর নিরুদ্দেশের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভুজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।
সূত্র: George X. Sand (October 1952). "Sea Mystery At Our Back Door" ও উইকিপিডিয়া
ফ্লাইট নাইনটিনের দূর্ঘটনাকে আমেরিকান লিজান (American Legion) ম্যগাজিনে ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখানো হয় (লেখক- Allen W. Eckert (April 1962). "The Lost Patrol". American Legion.)। সেসময়ে এই রহস্যময় ঘটনা নিয়ে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ১৯৬৪ সালে 'The Deadly Bermuda Triangle' নামের আরেকটি কাহিনী ছাপিয়ে এই আলোড়নে আরো মশলা যুক্ত করার দায়িত্ব পালন করেন ভিনসেন্ট গডিস (Vincent Gaddis) নামের এক লেখক। এর উপরেই আরো রং চড়িয়ে 'Invisible Horizons' নামের বিখ্যাত বইটি লেখা হয় যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে আরো রহস্যাবৃত করে তোলে। বারমুডার বিষয়ে লেখালেখি পাঠক প্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসলে প্রকাশিত হয় আরো কিছু লেখকের বই। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে ওয়ালেস স্পেন্সারের "লিম্বো অফ দ্যা লস্ট" (Limbo of the Lost, 1969, repr. 1973), রিচার্ড উইনারের "দ্যা ডেভিল'স ট্রায়াঙ্গেল" “শয়তানের ত্রিভুজ” (The Devil's Triangle, 1974) এবং চার্লস বার্লিটজ (Charles Berlitz)-এর সেই বিখ্যাত বই “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”(The Bermuda Triangle, 1974)। এদের প্রায় সকলেই ঘুরেফিরে একার্ট (Eckert) বর্ণিত অতিপ্রাকৃতিক ঘটানাই বিভিন্ন স্বাদে উপস্থাপন করেছেন। (Allen W. Eckert (April 1962). "The Lost Patrol". American Legion)।
এসব লেখকরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বিষয়ে কি লিখেছে সেটা আগ্রহীদের অনেকেই জানেন। সেগুলো বর্ননা করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না বরং এই ঘটনাগুলোর পেছনের ঘটনা ও এসব কাহিনীর বিষয়ে হওয়া বিভিন্ন গবেষণা নিয়ে আলোচনা করবো।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিভিন্ন রহস্য একটা দীর্ঘ সময় ধরে পাঠক প্রিয়তা পেলেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার ও আধুনিক স্যাটেলাইট ও নৌ যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। এসময়টায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে বেশ কিছু কৌতুহলী মানুষ ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা শুরু করে। “অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি”-র রিসার্চ লাইব্রেরিয়ান লরেন্স ডেভিড কুসচ ১৯৭৫ সালে "দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিস্ট্রি: সলভড" নামে একটি বই বের করেন যেখানে তিনি চার্লস বার্লিটজ (Charles Berlitz) এর বর্ণনার সাথে প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনার অসংগতিগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হন। যেমন- যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমান থাকার পরেও বার্লিটজ (Charles Berlitz) বিখ্যাত ইয়টসম্যান ডোনাল্ড ক্রোহার্সট(Donald Crowhurt) এর অন্তর্ধানকে বর্ণনা করেছেন রহস্য হিসেবে। আরও একটি উদাহরণ হল- আটলান্টিকের এক বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার তিন দিন পরে একটি আকরিকবাহী জাহাজের নিখোঁজ হবার কথা বার্লিটজ বর্ণনা করেছেন, আবার অন্য এক স্থানে একই জাহাজের কথা বর্ণনা করে বলেছেন সেটি নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বন্দর থেকে ছাড়ার পর নিখোঁজ হয়েছিল। এছাড়াও কুসচ(Kusche) দেখান যে বর্ণিত দূর্ঘটনার একটি বড় অংশই ঘটেছে কথিত ত্রিভুজের সীমানার বাইরে। অথবা সবগুলো ঘটনাকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে আনতে গেলে ট্রায়াঙ্গলের আকৃতি আর ট্রায়াঙ্গলের মত থাকে না (ছবি-১ দ্রষ্টব্য)। কুসচের গবেষণায় সহজভাবেই এসব লেখকের অসততা ফুটে ওঠে। তিনি লেখকদের বর্ণনায় বিভিন্ন দূর্ঘটনার তারিখ, সময় ইত্যাদি অনুযায়ী সে সময়ের খবরের কাগজ থেকে আবহাওয়ার খবর আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংগ্রহ করেছেন যা গল্পে লেখকরা বলেননি। অথচ এসব আবহাওয়ার খবর আর সমসাময়িক ফ্যাক্টগুলোর কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনাই অতি-সাধারণ দুর্ঘটনায় পরিনত হয়। কুসচের গবেষনায় বেশ চমৎকার কিছু বিষয় বের হয় আসে যা নিয়ে এর আগে কেউ ভাবেনি। তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-
* বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে যে পরিমান জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয় তার পরিমাণ বিশ্বের অন্যান সমুদ্রের তুলনায় বেশি নয়। মানে দুর্ঘটনার এই হার ঐ সময় স্বাভাবিকই ছিলো।
* এ অঞ্চলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় (tropical storms) নিয়মিত আঘাত হানে যা জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু বার্লিটজ বা অন্য লেখকেরা এধরনের ঝড়ের কথা অনেকাংশেই এড়িয়ে গিয়েছেন।
* অনেক ঘটনার বর্ণনাতেই লেখকেরা কল্পনার রং চড়িয়েছেন। আবার কোন নৌকা নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরিতে বন্দরে ভিড়লে তাকে নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়েছে।
* আবার কখনোই ঘটেনি এমন অনেক ঘটনার কথা লেখকেরা বরেছেন। যেমন- ১৯৩৭ সালে ফ্লোরিডার ডেটোনা সমুদ্রতীরে( Daytona Beach) একটি বিমান দূর্ঘটনার কথা বলা হয়, কিন্তু সেসময়ের খবরের কাগজ থেকে এ বিষয়ে কোন তথ্যই পাওয়া যায়নি।
কুসচ –এর গবেষণার উপসংহারে বলা যায়- লেখকরা অজ্ঞতার কারনে অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বানোয়াট রহস্য তৈরি করেছেন।
সূত্র: Lawrence David Kusche (1975). The Bermuda Triangle Mystery Solved. ISBN 0-87975-971-2
বারমুডাকে রহস্যময় হিসেবে প্রচার করে বেড়ানো লেখকেরা কলম্বাসের রেফারেন্স দিলেও বিশেষজ্ঞরা কলম্বাসের প্রকৃত লগবুক পরীক্ষা করে পেলেন ভিন্ন চিত্র। ১১ই অক্টোবর, ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত কলম্বাসের সেই লগের মূল অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
"The land was first seen by a sailor (Rodrigo de Triana), although the Admiral at ten o'clock that evening standing on the quarter-deck saw a light, but so small a body that he could not affirm it to be land; calling to Pero Gutiérrez, groom of the King's wardrobe, he told him he saw a light, and bid him look that way, which he did and saw it; he did the same to Rodrigo Sánchez of Segovia, whom the King and Queen had sent with the squadron as comptroller, but he was unable to see it from his situation. The Admiral again perceived it once or twice, appearing like the light of a wax candle moving up and down, which some thought an indication of land. But the Admiral held it for certain that land was near..."
সূত্র: ১১ই অক্টোবর, ১৪৯২ এ লিখিত কলম্বাসের নোটবুক
এই লগ পর্যবেক্ষন করে বিশেষজ্ঞরা যে মত দিয়েছেন তার সারমর্ম হল – নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন তা হল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন আর কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। আকাশে অদ্ভুত রকমের আলোচ্ছটার আরো বহুরকম ব্যাখ্যা রয়েছে। অরোরা বোরিয়ালিস (aurora borealis) তাদের ভেতরে অন্যতম (যদিও এটা মরু অঞ্চলে বেশী হয়)। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে নাবিকরা তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ ছিলো। আর তাদের ভেতরে কাজ করতো নানারকম কুসংস্কার, যা আগ্রহীদের সকলেই জানেন। কিছুদিন আগে আমরা সাগরের ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরনের যে অসাধারণ চিত্র দেখতে পেলাম তেমন কিছু তৎকালীন নাবিকরা দেখে কতরকম কাহিনী তৈরি করতো তা বলাই বাহুল্য...
ছবি: Underwater volcano erupts off the coast of Tonga's capital Nuku'alofa
(কলম্বাস ও তার নাবিকরা এধরনের কিছু দেখলে হয়তো গোটা সাগরকেই অশুভ কিছু ঘোষণা করে দিতেন...)
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের(USA) কোস্ট গার্ড ব্যাপক অনুসন্ধানের পর অনুমোদন করেছে এই অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
সূত্র: http://www.uscg.mil/hq/g-m/moa/reportindexcas.htm
বর্তমানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথিত রহস্যজনক এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়তই কোনরকম বিপদ ও অস্বাভাবিকতা ছাড়াই হাজার হাজার জাহাজ ও বিমান চলাচল করছে। এসব জাহাজ আর বিমান যেসকল প্রতিষ্ঠানে বীমা করা হয় তেমন একটি মেরিন বীমা কোম্পানী “লয়েড'স অব লন্ডন”(Lloyd's of London) অনুসন্ধান করে নিশ্চিত করেছে যে ঐ এলাকায় এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু নেই যার জন্য তারা ঐ অঞ্চল দিয়ে গমনকারী জাহাজের কাছ থেকে অতিরিক্ত মাশুল আদায় করতে পারে। উল্লেখ্য ঝুকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের কাছ থেকে বীমা কোম্পানী অতিরিক্ত মাশুল আদায় করে থাকে।
বারমুডাকে রহস্যাবৃত্ত করার কাজে নিয়োজিত অন্যতম লেখক John Wallace Spencer (1969) তাঁর Limbo Of The Lost বইয়ে ভি.এ. ফগ (V.A. Fogg) নামের একটি ট্যাঙ্কারের বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, "ঐ ট্যাঙ্কারের সব আরোহী অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র এর ক্যাপ্টেনকে তার কেবিনের টেবিলে হাতে কফির মগ ধরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে" (সূত্র- ১২.০ ১২.১ ১২.২ John Wallace Spencer (1969). Limbo Of The Lost. ISBN 0-686-10658-X)। অথচ কোস্ট গার্ডরা সে বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কারের ছবি তোলেন এবং বেশ কিছু মৃত দেহও উদ্ধার করেন (সূত্র- V A Fogg (PDF). USCG.)।
টিভি সিরিয়াল NOVA / Horizon এর “ দ্যা কেস অব দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (১৯৭৬-০৬-২৭)” পর্বে বলা হয়েছিল- "যে সব দূর্ঘটনার কথা বলা হয় সেগুলো ভিত্তিহীন"।
সূত্র: series = NOVA / Horizon (BBC TV series), "The Case of the Bermuda Triangle", airdate = 1976-06-27, network = PBS
১৯৪০ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দূর্ঘটনার জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো গেলেও ১৯৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১৯ বছরে তেমন কোন দোষ চাপানো যাচ্ছে না। তাহলে কি বারমুডার রহস্য হঠাৎ করে বাতাসে মিলিয়ে গেল? বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল খ্যাত অঞ্চলের কিছু অংশে স্থলভাগও রয়েছে। যেমন পোর্তো রিকো(Puerto Rico), বাহামা এমন কি বারমুডা নিজেই। এসব জায়গায় কোন রকম রহস্যের দেখা না পেয়েই মানুষজন নিশ্চিন্তেই বসবাস করে যাচ্ছে। এছাড়াও এই বারমুডার সীমানায় অবস্থিত ফ্রীপোর্ট শহরে বড়সড় জাহাজ কারখানা রয়েছে। সেখানে একটি বিমান বন্দরও রয়েছে যারা কোনরকম গোলযোগ ছাড়াই বছরে ৫০ হাজার বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
একটা সময়ে পুরো দুনিয়া ও সাগর জুড়েই ঘটে যেতো অনেক দুর্ঘটনা। এমনকি আজকের তথ্য-প্রযু্ক্তির যুগেও অনেক দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করা যায় না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির "এয়ার ক্রাশ ইনভেস্টিগেশন" সিরিজটা যারা দেখেন তারা বিষয়টা জানেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মত আরো বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে শুধু বারমুডাকেই কেন বিশেষ ভাবে হাইলাইট করা হলো? সংশয়বাদী গবেষকগণ (আর্নেস্ট ট্যাভস ( Ernest Taves)[২০] এবং ব্যারি সিংগার( Barry Singer) প্রমুখ) এই বিষয়ে গবেষণা করে বলেছেন, "মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভজনক। কারন তখন ঐ মিথ্যে রহস্যের উপর ভিত্তি করে বই লিখে বা টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ কামানো যায়।"
সূত্র: The Humanist, issue - 3, year - 1979, page p.44–45
- বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর "ন্যাকেড সায়েন্স" সিরিজে প্রচারিত একটি ফিচার রয়েছে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে ছড়ানো কল্পগল্পের অসারতা প্রমাণে ডিসকভারীও প্রচুর অবদান রেখেছিলো একসম (যদিও আজকাল ডিসকভারির ভারতীয় ভার্সনে বারমুডাকে রহস্যময় বলে প্রচার করা হয়)।
একবিংশ শতাব্দিতে এসে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যে পেছনের কাহিনী নিয়ে এত বেশী আলোচনা আর লেখালেখি হয়েছে যে সেগুলোর সবগুলো বা শুধু সারাংশও তুলে ধরতে গেলে একটা আস্ত বই হয়ে যাবে। সুতরাং বেছে বেছে খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু বিষয় তুলে ধরলাম মাত্র। তারপরও কেউ সংশয় মুক্ত হতে না পারলে নিচের বইগুলো সংগ্রহ করে পড়তে পারেন-
* Gian J. Quasar (2003). Into the Bermuda Triangle: Pursuing the Truth Behind the World's Greatest Mystery, (Reprinted in paperback (2005) ISBN 0-07-145217-6), International Marine / Ragged Mountain Press. ISBN 0-07-142640-X.
* Charles Berlitz (1974). The Bermuda Triangle, 1st, Doubleday. ISBN 0-385-04114-4.
* Lawrence David Kusche (1975). The Bermuda Triangle Mystery Solved. ISBN 0-87975-971-2.
* John Wallace Spencer (1969). Limbo Of The Lost. ISBN 0-686-10658-X.
* David Group (1984). The Evidence for the Bermuda Triangle. ISBN 0-85030-413-X.
* Daniel Berg (2000). Bermuda Shipwrecks. ISBN 0-9616167-4-1.
* Richard Winer (1974). The Devil's Triangle. ISBN 0553106880.
* Richard Winer (1975). The Devil's Triangle 2. ISBN 0553024647.
* Adi-Kent Thomas Jeffrey (1975). The Bermuda Triangle. ISBN 0446599611.
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল যা শয়তানের ত্রিভুজ নামেও পরিচিত এলাকাটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ ত্রিভুজাকার অঞ্চল যেখান বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রচারিত আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভৌগলিক অবস্থান নির্দিষ্ট নয়। কেউ মনে করেন এর আকার ট্রাপিজয়েডের মত, যা ছড়িয়ে আছে স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা, বাহামা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপূঞ্জ
এবং ইশোর (Azores) পূর্বদিকের আটলান্টিক অঞ্চল জুড়ে। আবার কেউ কেউ এগুলোর সাথে মেক্সিকোর উপসাগরকেও যুক্ত করেন। তবে লিখিত বর্ণনায় যে সকল অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে বুঝা যায় ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, সান হোয়ান (San Juan), পর্তু রিকো, মধ্য আটলান্টিকে বারমুডার দ্বীপপূঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডা স্ট্রেইটস এর দক্ষিণ সীমানা জুড়ে এটি বিস্তৃত। বিভিন্ন লেখক লেখায় বারমুডার যে বিচিত্র-ম্যাপ পাওয়া যায় তা নিন্মরুপ-
bermuda triangle area
ছবি সূত্র: উইকিপিডিয়া
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিষয়ে বিভিন্ন লেখক রেফারেন্স হিসেবে সর্বপ্রথম ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। কলম্বাস লিখেছিলেন যে তাঁর জাহাজের নবিকেরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন।
১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর সর্বপ্রথম এ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে খবরের কাগজে লিখেন ই. ভি. ডব্লিউ. জোন্স( E.V.W. Jones)। এর দুই বছর পরেই এই বিষয়ে ফেইট (Fate)ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড( George X. Sand) "Sea Mystery At Our Back Door" শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন ( ইউ এস নেভী-র পাঁচটি ‘টি বি এম অ্যাভেন্জার’ বিমানের একটি দল, যা প্রশিক্ষণ মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়) এর নিরুদ্দেশের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভুজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।
সূত্র: George X. Sand (October 1952). "Sea Mystery At Our Back Door" ও উইকিপিডিয়া
ফ্লাইট নাইনটিনের দূর্ঘটনাকে আমেরিকান লিজান (American Legion) ম্যগাজিনে ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখানো হয় (লেখক- Allen W. Eckert (April 1962). "The Lost Patrol". American Legion.)। সেসময়ে এই রহস্যময় ঘটনা নিয়ে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ১৯৬৪ সালে 'The Deadly Bermuda Triangle' নামের আরেকটি কাহিনী ছাপিয়ে এই আলোড়নে আরো মশলা যুক্ত করার দায়িত্ব পালন করেন ভিনসেন্ট গডিস (Vincent Gaddis) নামের এক লেখক। এর উপরেই আরো রং চড়িয়ে 'Invisible Horizons' নামের বিখ্যাত বইটি লেখা হয় যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে আরো রহস্যাবৃত করে তোলে। বারমুডার বিষয়ে লেখালেখি পাঠক প্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসলে প্রকাশিত হয় আরো কিছু লেখকের বই। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে ওয়ালেস স্পেন্সারের "লিম্বো অফ দ্যা লস্ট" (Limbo of the Lost, 1969, repr. 1973), রিচার্ড উইনারের "দ্যা ডেভিল'স ট্রায়াঙ্গেল" “শয়তানের ত্রিভুজ” (The Devil's Triangle, 1974) এবং চার্লস বার্লিটজ (Charles Berlitz)-এর সেই বিখ্যাত বই “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”(The Bermuda Triangle, 1974)। এদের প্রায় সকলেই ঘুরেফিরে একার্ট (Eckert) বর্ণিত অতিপ্রাকৃতিক ঘটানাই বিভিন্ন স্বাদে উপস্থাপন করেছেন। (Allen W. Eckert (April 1962). "The Lost Patrol". American Legion)।
এসব লেখকরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বিষয়ে কি লিখেছে সেটা আগ্রহীদের অনেকেই জানেন। সেগুলো বর্ননা করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না বরং এই ঘটনাগুলোর পেছনের ঘটনা ও এসব কাহিনীর বিষয়ে হওয়া বিভিন্ন গবেষণা নিয়ে আলোচনা করবো।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিভিন্ন রহস্য একটা দীর্ঘ সময় ধরে পাঠক প্রিয়তা পেলেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার ও আধুনিক স্যাটেলাইট ও নৌ যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। এসময়টায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে বেশ কিছু কৌতুহলী মানুষ ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা শুরু করে। “অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি”-র রিসার্চ লাইব্রেরিয়ান লরেন্স ডেভিড কুসচ ১৯৭৫ সালে "দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিস্ট্রি: সলভড" নামে একটি বই বের করেন যেখানে তিনি চার্লস বার্লিটজ (Charles Berlitz) এর বর্ণনার সাথে প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনার অসংগতিগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হন। যেমন- যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমান থাকার পরেও বার্লিটজ (Charles Berlitz) বিখ্যাত ইয়টসম্যান ডোনাল্ড ক্রোহার্সট(Donald Crowhurt) এর অন্তর্ধানকে বর্ণনা করেছেন রহস্য হিসেবে। আরও একটি উদাহরণ হল- আটলান্টিকের এক বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার তিন দিন পরে একটি আকরিকবাহী জাহাজের নিখোঁজ হবার কথা বার্লিটজ বর্ণনা করেছেন, আবার অন্য এক স্থানে একই জাহাজের কথা বর্ণনা করে বলেছেন সেটি নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বন্দর থেকে ছাড়ার পর নিখোঁজ হয়েছিল। এছাড়াও কুসচ(Kusche) দেখান যে বর্ণিত দূর্ঘটনার একটি বড় অংশই ঘটেছে কথিত ত্রিভুজের সীমানার বাইরে। অথবা সবগুলো ঘটনাকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে আনতে গেলে ট্রায়াঙ্গলের আকৃতি আর ট্রায়াঙ্গলের মত থাকে না (ছবি-১ দ্রষ্টব্য)। কুসচের গবেষণায় সহজভাবেই এসব লেখকের অসততা ফুটে ওঠে। তিনি লেখকদের বর্ণনায় বিভিন্ন দূর্ঘটনার তারিখ, সময় ইত্যাদি অনুযায়ী সে সময়ের খবরের কাগজ থেকে আবহাওয়ার খবর আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংগ্রহ করেছেন যা গল্পে লেখকরা বলেননি। অথচ এসব আবহাওয়ার খবর আর সমসাময়িক ফ্যাক্টগুলোর কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনাই অতি-সাধারণ দুর্ঘটনায় পরিনত হয়। কুসচের গবেষনায় বেশ চমৎকার কিছু বিষয় বের হয় আসে যা নিয়ে এর আগে কেউ ভাবেনি। তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-
* বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে যে পরিমান জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয় তার পরিমাণ বিশ্বের অন্যান সমুদ্রের তুলনায় বেশি নয়। মানে দুর্ঘটনার এই হার ঐ সময় স্বাভাবিকই ছিলো।
* এ অঞ্চলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় (tropical storms) নিয়মিত আঘাত হানে যা জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু বার্লিটজ বা অন্য লেখকেরা এধরনের ঝড়ের কথা অনেকাংশেই এড়িয়ে গিয়েছেন।
* অনেক ঘটনার বর্ণনাতেই লেখকেরা কল্পনার রং চড়িয়েছেন। আবার কোন নৌকা নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরিতে বন্দরে ভিড়লে তাকে নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়েছে।
* আবার কখনোই ঘটেনি এমন অনেক ঘটনার কথা লেখকেরা বরেছেন। যেমন- ১৯৩৭ সালে ফ্লোরিডার ডেটোনা সমুদ্রতীরে( Daytona Beach) একটি বিমান দূর্ঘটনার কথা বলা হয়, কিন্তু সেসময়ের খবরের কাগজ থেকে এ বিষয়ে কোন তথ্যই পাওয়া যায়নি।
কুসচ –এর গবেষণার উপসংহারে বলা যায়- লেখকরা অজ্ঞতার কারনে অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বানোয়াট রহস্য তৈরি করেছেন।
সূত্র: Lawrence David Kusche (1975). The Bermuda Triangle Mystery Solved. ISBN 0-87975-971-2
বারমুডাকে রহস্যময় হিসেবে প্রচার করে বেড়ানো লেখকেরা কলম্বাসের রেফারেন্স দিলেও বিশেষজ্ঞরা কলম্বাসের প্রকৃত লগবুক পরীক্ষা করে পেলেন ভিন্ন চিত্র। ১১ই অক্টোবর, ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত কলম্বাসের সেই লগের মূল অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
"The land was first seen by a sailor (Rodrigo de Triana), although the Admiral at ten o'clock that evening standing on the quarter-deck saw a light, but so small a body that he could not affirm it to be land; calling to Pero Gutiérrez, groom of the King's wardrobe, he told him he saw a light, and bid him look that way, which he did and saw it; he did the same to Rodrigo Sánchez of Segovia, whom the King and Queen had sent with the squadron as comptroller, but he was unable to see it from his situation. The Admiral again perceived it once or twice, appearing like the light of a wax candle moving up and down, which some thought an indication of land. But the Admiral held it for certain that land was near..."
সূত্র: ১১ই অক্টোবর, ১৪৯২ এ লিখিত কলম্বাসের নোটবুক
এই লগ পর্যবেক্ষন করে বিশেষজ্ঞরা যে মত দিয়েছেন তার সারমর্ম হল – নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন তা হল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন আর কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। আকাশে অদ্ভুত রকমের আলোচ্ছটার আরো বহুরকম ব্যাখ্যা রয়েছে। অরোরা বোরিয়ালিস (aurora borealis) তাদের ভেতরে অন্যতম (যদিও এটা মরু অঞ্চলে বেশী হয়)। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে নাবিকরা তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ ছিলো। আর তাদের ভেতরে কাজ করতো নানারকম কুসংস্কার, যা আগ্রহীদের সকলেই জানেন। কিছুদিন আগে আমরা সাগরের ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরনের যে অসাধারণ চিত্র দেখতে পেলাম তেমন কিছু তৎকালীন নাবিকরা দেখে কতরকম কাহিনী তৈরি করতো তা বলাই বাহুল্য...
ছবি: Underwater volcano erupts off the coast of Tonga's capital Nuku'alofa
(কলম্বাস ও তার নাবিকরা এধরনের কিছু দেখলে হয়তো গোটা সাগরকেই অশুভ কিছু ঘোষণা করে দিতেন...)
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের(USA) কোস্ট গার্ড ব্যাপক অনুসন্ধানের পর অনুমোদন করেছে এই অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
সূত্র: http://www.uscg.mil/hq/g-m/moa/reportindexcas.htm
বর্তমানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথিত রহস্যজনক এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়তই কোনরকম বিপদ ও অস্বাভাবিকতা ছাড়াই হাজার হাজার জাহাজ ও বিমান চলাচল করছে। এসব জাহাজ আর বিমান যেসকল প্রতিষ্ঠানে বীমা করা হয় তেমন একটি মেরিন বীমা কোম্পানী “লয়েড'স অব লন্ডন”(Lloyd's of London) অনুসন্ধান করে নিশ্চিত করেছে যে ঐ এলাকায় এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু নেই যার জন্য তারা ঐ অঞ্চল দিয়ে গমনকারী জাহাজের কাছ থেকে অতিরিক্ত মাশুল আদায় করতে পারে। উল্লেখ্য ঝুকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের কাছ থেকে বীমা কোম্পানী অতিরিক্ত মাশুল আদায় করে থাকে।
বারমুডাকে রহস্যাবৃত্ত করার কাজে নিয়োজিত অন্যতম লেখক John Wallace Spencer (1969) তাঁর Limbo Of The Lost বইয়ে ভি.এ. ফগ (V.A. Fogg) নামের একটি ট্যাঙ্কারের বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, "ঐ ট্যাঙ্কারের সব আরোহী অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র এর ক্যাপ্টেনকে তার কেবিনের টেবিলে হাতে কফির মগ ধরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে" (সূত্র- ১২.০ ১২.১ ১২.২ John Wallace Spencer (1969). Limbo Of The Lost. ISBN 0-686-10658-X)। অথচ কোস্ট গার্ডরা সে বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কারের ছবি তোলেন এবং বেশ কিছু মৃত দেহও উদ্ধার করেন (সূত্র- V A Fogg (PDF). USCG.)।
টিভি সিরিয়াল NOVA / Horizon এর “ দ্যা কেস অব দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (১৯৭৬-০৬-২৭)” পর্বে বলা হয়েছিল- "যে সব দূর্ঘটনার কথা বলা হয় সেগুলো ভিত্তিহীন"।
সূত্র: series = NOVA / Horizon (BBC TV series), "The Case of the Bermuda Triangle", airdate = 1976-06-27, network = PBS
১৯৪০ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দূর্ঘটনার জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো গেলেও ১৯৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১৯ বছরে তেমন কোন দোষ চাপানো যাচ্ছে না। তাহলে কি বারমুডার রহস্য হঠাৎ করে বাতাসে মিলিয়ে গেল? বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল খ্যাত অঞ্চলের কিছু অংশে স্থলভাগও রয়েছে। যেমন পোর্তো রিকো(Puerto Rico), বাহামা এমন কি বারমুডা নিজেই। এসব জায়গায় কোন রকম রহস্যের দেখা না পেয়েই মানুষজন নিশ্চিন্তেই বসবাস করে যাচ্ছে। এছাড়াও এই বারমুডার সীমানায় অবস্থিত ফ্রীপোর্ট শহরে বড়সড় জাহাজ কারখানা রয়েছে। সেখানে একটি বিমান বন্দরও রয়েছে যারা কোনরকম গোলযোগ ছাড়াই বছরে ৫০ হাজার বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
একটা সময়ে পুরো দুনিয়া ও সাগর জুড়েই ঘটে যেতো অনেক দুর্ঘটনা। এমনকি আজকের তথ্য-প্রযু্ক্তির যুগেও অনেক দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করা যায় না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির "এয়ার ক্রাশ ইনভেস্টিগেশন" সিরিজটা যারা দেখেন তারা বিষয়টা জানেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মত আরো বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে শুধু বারমুডাকেই কেন বিশেষ ভাবে হাইলাইট করা হলো? সংশয়বাদী গবেষকগণ (আর্নেস্ট ট্যাভস ( Ernest Taves)[২০] এবং ব্যারি সিংগার( Barry Singer) প্রমুখ) এই বিষয়ে গবেষণা করে বলেছেন, "মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভজনক। কারন তখন ঐ মিথ্যে রহস্যের উপর ভিত্তি করে বই লিখে বা টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ কামানো যায়।"
সূত্র: The Humanist, issue - 3, year - 1979, page p.44–45
- বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর "ন্যাকেড সায়েন্স" সিরিজে প্রচারিত একটি ফিচার রয়েছে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে ছড়ানো কল্পগল্পের অসারতা প্রমাণে ডিসকভারীও প্রচুর অবদান রেখেছিলো একসম (যদিও আজকাল ডিসকভারির ভারতীয় ভার্সনে বারমুডাকে রহস্যময় বলে প্রচার করা হয়)।
একবিংশ শতাব্দিতে এসে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যে পেছনের কাহিনী নিয়ে এত বেশী আলোচনা আর লেখালেখি হয়েছে যে সেগুলোর সবগুলো বা শুধু সারাংশও তুলে ধরতে গেলে একটা আস্ত বই হয়ে যাবে। সুতরাং বেছে বেছে খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু বিষয় তুলে ধরলাম মাত্র। তারপরও কেউ সংশয় মুক্ত হতে না পারলে নিচের বইগুলো সংগ্রহ করে পড়তে পারেন-
* Gian J. Quasar (2003). Into the Bermuda Triangle: Pursuing the Truth Behind the World's Greatest Mystery, (Reprinted in paperback (2005) ISBN 0-07-145217-6), International Marine / Ragged Mountain Press. ISBN 0-07-142640-X.
* Charles Berlitz (1974). The Bermuda Triangle, 1st, Doubleday. ISBN 0-385-04114-4.
* Lawrence David Kusche (1975). The Bermuda Triangle Mystery Solved. ISBN 0-87975-971-2.
* John Wallace Spencer (1969). Limbo Of The Lost. ISBN 0-686-10658-X.
* David Group (1984). The Evidence for the Bermuda Triangle. ISBN 0-85030-413-X.
* Daniel Berg (2000). Bermuda Shipwrecks. ISBN 0-9616167-4-1.
* Richard Winer (1974). The Devil's Triangle. ISBN 0553106880.
* Richard Winer (1975). The Devil's Triangle 2. ISBN 0553024647.
* Adi-Kent Thomas Jeffrey (1975). The Bermuda Triangle. ISBN 0446599611.
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন