আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

সোমবার, আগস্ট ১৮, ২০১৪

ব্ল্যাক হোলের 'মিসিং লিংক' আবিষ্কৃত হলো !




তারার মত ভরবিশিষ্ট ছোট কৃষ্ণ বিবরগুলো আশপাশের গ্যাস নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার সময় এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়।
কিন্তু ডারহাম ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন, এখন তারা অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর (সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল) থেকেও এ ধরণের এক্স-রশ্মির সন্ধান পেয়েছেন। ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত যে অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের ভর সূর্যের তুলনায় কয়েক মিলিয়ন গুণ বেশী, সম্প্রতি সেগুলোর কাছ থেকে আসা এক্স-রশ্মি সনাক্ত করা হয়েছে।
১৭ই সেপ্টেম্বর ডারহামের গবেষক দল নেচার পত্রিকায় এই সনাক্তকরণের ফল প্রকাশ করেছেন।
গবেষকরা বলছেন, এই রশ্মির মাধ্যমে অনেক দূরের অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরগুলোর ভর পরিমাপ করা যাবে এবং তাদের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানা যাবে।
তারা ইউরোপের "নিউটন-এক্সএমএম" (Newton-XMM) মহাকাশ দুরবিন ব্যবহার করে "REJ1034+396" নামক ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এমন সময়ই এই কৃষ্ণ বিবর থেকে আসা বিস্ময়কর এক্স-রশ্মির স্পন্দন (কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন) ধরা পড়ে।
অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর
কৃষ্ণ বিবর জন্মের ইতিহাসটা প্রায় সবারই জানা। তারার সব জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, অভিকর্ষের প্রভাবে তা কেন্দ্রের দিকে ধ্বসে পড়তে থাকে। সংকোচনের কারণে তাপ বাড়তে থাকে। তাপ অনেক বেড়ে গেলে হিলিয়াম সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন ও কার্বন তৈরী শুরু করে। এর ফলে আবার ভারসাম্য ফিরে আসে। এ সময় যে বিক্রিয়া চলে তা বেশ অস্থিতিশীল। এ সময়ই বিক্রিয়ার পরিমাণ হঠাৎ খুব বেড়ে যাওয়া বা অন্যান্য কারণে তারার বহির্ভাগ আলগা হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে গ্রহ নীহারিকা তৈরী হতে পারে, আবার তীব্র বিস্ফোরণ হলে অতিনবতারাও তৈরী হতে পারে।
বহির্ভাগ চলে যাওয়ার পর কেন্দ্রে যে অবশেষ থাকে তার ভরের উপরই নির্ভর করে তারার পরবর্তী দশা। এই অবশেষের ভরও যদি সূর্যের ভরের ৩-৪ গুণ হয় তাহলে তা আবার কেন্দ্রের দিকে ধ্বসে পড়তে থাকে। কেউই তার ধ্বস ঠেকাতে পারে না। ফলে তার অভিকর্ষ বল বাড়তেই থাকে। অভিকর্ষ বল বাড়তে থাকলে একসময় কোন কিছুই তার বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না। অর্থাৎ তারার অভিকর্ষ বল কোন কিছুকেই পালাতে দেয় না, এমনকি আলোকেও না। অর্থাৎ তার মুক্তিবেগ হয় আলোর বেগের চেয়ে বেশী। আলোও আসতে পারে না বলে তাকে দেখা যায় না, এজন্যই বলে কৃষ্ণ বিবর।
এতো গেল তারার মত ভরবিশিষ্ট কৃষ্ণ বিবরের কথা। এগুলোকে ছোট বিবর বলা যায়। কিন্তু অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের ভর সূর্যের ভরের কয়েক মিলিয়ন গুণ হয়ে থাকে। এই কৃষ্ণ বিবরগুলোর উৎপত্তি বিভিন্নভাবে হতে পারে:
-
ছোট কৃষ্ণ বিবরের অভিকর্ষ বলের কারণে সবকিছু তার ভেতর ঢুকতে থাকে। এভাবে খেতে খেতে অনেক সময়ের ব্যবধানে একটি ছোট কৃষ্ণ বিবর অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হতে পারে।
-
একটিমাত্র গ্যাসীয় মেঘ থেকে অনেক অনেক তারা তৈরী হয়। এমন কোন বিশাল গ্যাসীয় মেঘের ভেতর কিছু নির্দিষ্ট ভারসাম্যহীনতার কারণে পুরোটাই একবারে কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হতে পারে।
-
ঘন তারা স্তবকে অবস্থিত সবগুলো তারা একসাথে হয়ে কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হতে পারে।
-
মহা বিস্ফোরণের পরপর যে বিপুল চাপ ছিল তার কারণে কিছু আদিম অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর তৈরী হতে পারে।
আমাদের লক্ষ্য এই অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর যাদের সাথে ছোটগুলোর বেশ কিছু পার্থক্য আছে। তবে ডারহামের গবেষণার মাধ্যমে এরকমই একটি পার্থক্য দূরীভূত হয়েছে। অর্থাৎ আমরা জানতে পেরেছি, সব কৃষ্ণ বিবরের আশপাশ থেকেই এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়। অবশ্য বড়গুলোর এক্স-রশ্মির স্পন্দনের সাথে ছোট গুলোর স্পন্দনের পার্থক্য আছে।
কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন (কিউপিও)
শুধু কৃষ্ণ বিবর না যেকোন ঘন তারার আশপাশ থেকে এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়। ঘন তারা বলতে এমন ধরণের তারাকে বোঝানো হয় যাদের আয়তন কম হলেও ভর অনেক বেশী। এর মধ্যে পড়ে, শ্বেত বামন, নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণ বিবর। ঘন তারা থেকে আমরা সাধারণ এক্স-রশ্মি ছাড়াও এক বিশেষ ধরণের এক্স-রশ্মি পাই যার নাম "কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন" (Quasi-periodic oscillation) বা "কিউপিও"। এটাই আমাদের আগ্রহের বিষয়। কারণ এর মাধ্যমেই ঘন তারার ভর নির্ণয় করা যায়। ছোট-বড় সব ধরণের কৃষ্ণ বিবরের আশপাশ থেকেই কিউপিও নিসৃত হয়, যদিও এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যে আসার আগে এক্স-রশ্মি ও কিউপিও নিয়ে কিছু বলে নেয়া প্রয়োজন।
ভিনের সরণ সূত্র অনুসারে আমরা জানি কোন বস্তু থেকে আসা সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য তার তাপমাত্রার ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ কোন বস্তুর তাপমাত্রা যত বাড়বে তা থেকে নিসৃত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কম হবে। এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য (১০-০.১ ন্যানোমিটার) যেহেতু অনেক কম সেহেতু তা সৃষ্টি করার জন্য বস্তুর তাপমাত্রা অনেক বেশী হতে হবে। এমনকি সূর্যের তাপমাত্রাও ততোটা বেশী না। কিন্তু ঘন তারার চারপাশে মাঝে মাঝে এমন তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়।
ঘন তারা আশাপাশের গ্যাস নিজের ভেতর টেনে নেয়। গ্যসপিণ্ডের নিজস্ব ঘূর্ণন বেগ থাকার কারণে তা ঘন তারার চারপাশে ঘুরতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে যেতে থাকে। এই গ্যাসীয় পিণ্ডের সাথে ঘন তারার তলের ঘর্ষণের কারণে বিপুল তাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চ তাপমাত্রায়ই এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়।
কিউপিও এক ধরণের এক্স রশ্মি স্পন্দন। তবে এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন:
-
কম্পাঙ্ক বনাম শক্তি লেখ আঁকলে দেখা যায়, কিছু কম্পাঙ্কে শক্তি সর্বোচ্চ মানে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ স্পন্দনে শক্তি যেমন একটিমাত্র কম্পাঙ্কে সর্বোচ্চ মানে পৌঁছায়, এখানে তেমনটি হয় না। এখানে অনেকগুলো কম্পাঙ্কের ব্যান্ডে একসাথে সর্বোচ্চ শক্তির দেখা মিলে।
-
বিকিরণের তীব্রতা নির্দিষ্ট সময় পরপর বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিকভাবে তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। শক্তির সর্বোচ্চ মানের অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই তীব্রতার এই হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
-
মোট স্পন্দনের পরিমাণ হঠাৎ করে শুরু হয় এবং এক্সপোনেনশিয়াল ভাবে কমতে থাকে।
দুর্বলভাবে চুম্বকায়িত নিউট্রন তারার মাধ্যমে কিউপিও'র এ ধরণের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা যায়। ধরি একটি গ্যাসীয় পিণ্ড নিউট্রন তারাটির চারদিকে ঘুরছে এবং ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে প্রবেশ করছে। যখনই পিণ্ডটি চৌম্বক মেরুর কাছে আসবে তখনই তার কিছু অংশ তারার ভেতর ঢুকে যাবে এবং বিপুল পরিমাণ এক্স-রশ্মি উৎপন্ন হবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর যেহেতু চৌম্বক মেরুর কাছে আসবে তাই বিকিরণের তীব্রতাও নির্দিষ্ট সময় পরপর সর্বোচ্চ মানে পৌঁছুবে। আর ঐ স্থানে পৌঁছানোর পর পিণ্ডের ভর যেহেতু কমে যাবে সেহেতু মোট স্পন্দনের পরিমাণও কমে যাবে।
কৃষ্ণ বিবরের কিউপিও
প্রথমে ছোট কৃষ্ণ বিবরের কিউপিও'র কথায় আসা যাক। কৃষ্ণ বিবর হল সর্বভুক। আশপাশের সবকিছুকে খেয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু সবকিছুরই কৌণিক বেগ থাকার কারণে সেগুলো কৃষ্ণ বিবরের চারদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে বিবরের ভেতর প্রবেশ করে। চারপাশের ঘূর্ণনশীল বস্তুগুলো যখন কৃষ্ণ বিবরের ঘটনা দিগন্তের সংস্পর্শে আসে তখনই তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই তাপমাত্রায় বস্তুগুলো বিপুল পরিমাণ এক্স-রশ্মি নিঃসরণ করতে থাকে। এই বিকিরণের তীব্রতা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর সর্বোচ্চ মানে পৌঁছে। এটাকেই কিউপিও'র পর্যায়কাল বলা যেতে পারে। ছোট কৃষ্ণ বিবরের জন্য এই পর্যায়কাল খুব ছোট, কয়েক সেকেন্ড হতে পারে।
কিন্তু অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের জন্য এই তীব্রতার পর্যায়কাল অনেক বড়, কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনও হতে পারে। এখানেই ছোটগুলোর সাথে তার পার্থক্য। এই পার্থক্যের কারণটা এরকম: ঘূর্ণায়মান বস্তু ঘটনা দিগন্ত স্পর্শ করা মাত্রই বিকিরণের তীব্রতা বেড়ে যায়। ছোট কৃষ্ণ বিবরের ঘটনা দিগন্ত বেশ ছোট ব্যাসার্ধ্যের, পাশাপাশি যে যে অঞ্চলে ঘূর্ণায়মান বস্তু বিবরের ভেতর ঢুকে সে অঞ্চলও ছোট বিবরের ক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পরপর আসে। কিন্তু বিবরের ভর যত বেশী হবে তার এ ধরণের প্রবেশমুখগুলো ততই দূরে দূরে থাকবে। এ কারণেই অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর থেকে আসা কিউপিও'র তীব্রতার পর্যায়কাল অনেক বেশী।
এই কিউপিও থেকেই বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণ বিবরের ভর নির্ণয় করেন। সম্পর্কটা তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন, কিউপিও'র কম্পাঙ্ক কৃষ্ণ বিবরের ভরের উপর নির্ভর করে। এই সম্পর্ক থেকে ভর বের করাটা খুব কঠিন না।
গুরুত্ব বিচার
এবার ডারহামের বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। তারা মহাবিশ্বের একটা বড়সড় রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি পেয়ে গেছেন। সেটা হল অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর। আমাদের আকাশগঙ্গার মত ছায়াপথের প্রায় সবগুলোর কেন্দ্রেই অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর আছে। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রেও আছে। এই বিবর এতোদিন কেবল রহস্য বাড়িয়েই গেছে। এবার তার ধরা দেবার পালা। শুধুমাত্র এই কিউপিও পর্যবেক্ষণ করে তার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে নেয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারকে ছোট ও অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের মধ্যে একটি "মিসিং লিংক" হিসেবে বর্ণনা করছেন। এবার আরও বিস্তারিতভাবে জানা যাবে, অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরেরা কেনো এতো পৃথক?
কৃষ্ণ বিবর মহাবিশ্বের রহস্য উন্মচনেও বিশাল ভূমিকা রাখে। এর ভেতরে কি ঘটে তা বিজ্ঞানীরা এখনও জানতে পারেননি। সে জায়গাটা যেন অজ্ঞানতার প্রতিনিধিত্ব করে। সেখান থেকে আলো আসে না, আলো ছাড়া আমরা জানতেও পারি না। আলোই এখন পর্যন্ত আমাদের জ্ঞানার্জনের প্রধান বাহন হয়ে আছে। তবে এক্স-রশ্মি আর বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে হয়ত আর আলোর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। আলো দিয়ে আর কত দেখব? এবার আলো দিয়ে অন্ধকার জয়ের পরিবর্তে অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার জয়ের পালা।
*****
ব্যবহৃত পরিভাষা
Black hole - কৃষ্ণ বিবর
Event horizon -
ঘটনা দিগন্ত
Neutron star -
নিউট্রন তারা
Quasi-periodic oscillations -
কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন
Supermassive black hole -
অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর
Supernova -
অতিনবতারা
White dwarf -
শ্বেত বামন
তথ্যসূত্র:
# Scientists Find Black Hole 'Missing Link' - সায়েন্স ডেইলি
# X-ray pulse seen in biggest holes -
বিবিসি
# Super-massive and Small Black Holes Both Suck -
ইউনিভার্স টুডে

লেখকঃ শিক্ষানবিশ (সচলায়তন)