২।
আলোর গল্পটা অনেক পুরানো। এককালে মানুষ ভাবত যে, মানুষ চোখ থেকে আলো বের করে তবেই দেখে। কি সর্বনেশে কথা, নাক দিয়ে সর্দি বের করছি, মুখ দিয়ে থুতু বের করছি, পেছন দিয়ে হাগু বের করছি, ইয়ে দিয়ে... ... নাহ, থাক। মানে বলছিলাম কি, এত কিছুর পরে চোখ দিয়ে আবার সুপারম্যানের মত আলোও বের করতে হবে? কাভি নেহি! কথাটা বলেছিলেন আল হাজেন নামে এক বিজ্ঞানী। শের শাহের আগে যেমন ঘোড়া ডাকত না, প্রিস্টলীর আগে যেমন মানুষ অক্সিজেন ছাড়াই বেশ নিঃশ্বাস নিত, আল হাজেনের আগে মানুষ তেমনি চোখ থেকে আলো বের করে তবে দেখত। যাহোক, তখন থেকেই বস্তু থেকে চোখে আলো এসে পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে আসল নিত্য নতুন তত্ত্ব। নিউটন যেমন ভাবতেন আলো হল গিয়ে বিলিয়ার্ড বল কিংবা বুলেটের মত। আরো বললেন বিভিন্ন আকারের বুলেটের জন্য আমরা বিভিন্ন রঙ দেখি। মানে, গোল বুলেটের জন্য লাল আলো হলে চারকোণা বুলেটের জন্য সবুজ আলো, এমন। আলোর আবার নানান খেলা দেখাবার অভ্যাস আছে। যেমন দেয়ালে বলের মত ড্রপ খেয়ে ফিরে আসা (বা প্রতিফলন), অথবা বাতাস থেকে পানিতে ডুব দেবার সময় দিক বদলে বেকে যাওয়া (বা প্রতিসরণ)। কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে টিকে থাকতে হলে তাকে পরীক্ষায় মানে ব্যাবহারিক পরীক্ষায় পাস করতে হয়। আবার আশে-পাশে যা ঘটে তাকে ব্যাখ্যা করতেও পারতে হয়। এখন, আলো নতুন খেলা দেখানোর আগ পর্যন্ত এই তত্ত্ব বহুদিন টিকে ছিল, কারন তা দিয়ে আলোর দেখানো সব প্রচলিত খেলাই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। গোল বাধালেন বিজ্ঞানী ইয়ং।
৩।
পানিতে একটা আঙ্গুল চোবালে কি হয়? ঢেউ, ঠিক ধরেছেন। কিভাবে? যেখানে আঙুল চোবাচ্ছেন সেখান থেকে বৃত্তের মত গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে না? একটা উচু বৃত্ত তারপর একটা নিচু বৃত্ত। আবার উঁচু, আবার নিচু, কুচকাওয়াজের লেফট-রাইট-লেফট-রাইটের মত এই উঁচু-নিচু-উঁচু-নিচু বৃত্তকাওয়াজ চলতেই থাকে। কিন্তু দুটো আঙুল চোবালে? তখন? তখন দেখা যাবে দু’আঙ্গুলের মাথা থেকে দুটো বৃত্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এই পর্যন্ত কোনই সমস্যা নেই। সমস্যা হল যেখানে বৃত্তকাওয়াজের দুই দল একজনের ওপর দিয়ে আরেকজন পার হতে যায়, ঠিক সেখানে। কোথাও দেখা যায় দুই দলই এক যোগে উঁচুর ধাতে ছিল, সেখানটা আরও বেশি উঁচু হয়ে ওঠে। কোথাও আবার দেখা যায় দুই দলই এক যোগে নিচুর ধাতে ছিল, সেখানটা আরও বেশি নিচু হয়ে ওঠে। মুশকিল হয় সেই সব জায়গায়, যেখানে এক দল উঁচু আরেক দল নিচু হতে চাচ্ছে। সেখানটাতে দেখা যায় পানি উঠছেও না, নামছেও না- ঢেউ আসার আগে পানির লেভেল যেখানে ছিল, ওই অংশেও পানির লেভেল সেখানেই আছে, অথচ বৃত্তকাওয়াজ ঠিকই পার হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ দুটো ঢেউ মুখোমুখি হয়ে গেলে শিবিরের মত মারামারি না করে একটার মধ্যে দিয়ে আরেকটা চলে যায়, যাবার সময় কোথাও বেশি উঁচু, কোথাও বেশি নিচু বা কোথাও সমান হয়ে যায়। ঢেউয়ের এই অভ্যাসের পোশাকি নাম ব্যাতিচার। ঢেউয়ের সমবর্তন বা অপবর্তন ইত্যাদি বাহারি নামের এমন আর কিছু অভ্যাস আছে। মুশকিল হল ইয়ং তাঁর এক পরীক্ষায় আলোর ব্যাতিচার দেখে ফেললেন। হাইগেনস নামের আরেক বিজ্ঞানী আবার সেজন্য ঠেলেঠুলে একটা তত্ত্বও দাঁড় করিয়ে ফেললেন।
৪।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের বিজ্ঞান বইগুলোতে বড় বড় করে লেখা থাকে অমুক বিজ্ঞানী বলেছেন “আলো এক প্রকার কণা” কিংবা তমুক বিজ্ঞানী বলেছেন “আলো এক প্রকার তরঙ্গ”। ব্যাস মাথা খাওয়া শেষ। জোকাই লামার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের চাইতে এই সব বিভ্রান্তিকর কথাগুলোও কম ক্ষতিকর নয়। আসল কথাটা হল, আলো কখনও কখনও কণার মত আচরন করে কখনও বা তরঙ্গের মত। তার মানে এই নয় যে আলোকে পুরোপুরি “কণা” বা “তরঙ্গ” হয়ে যেতে হবে। সাহানা বাজপেয়ী’র রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার চমৎকার লাগে, এখণ কি বলব যে “সাহানা বাজপেয়ী এক প্রকার রবীন্দ্রসঙ্গীত”? কিংবা মেসি দুর্দান্ত ফুটবল খেলে বলে কি বলতে হবে যে “মেসি এক প্রকার ফুটবল”? মোটেই না! তবে আলোর ওপর কেন এই মিছে অত্যাচার। যাহোক, এটা ঠিক যে, আলো বড়ই অদ্ভুদ! ক্যারমের স্ট্রাইকার যেমন অন্য গুটিদের ছিটকে দিতে পারে, আলোও তেমন গুঁতো দিয়ে ইলেকট্রন ইত্যাদিকে ছিটকে দিতে পারে- এটা “আলোর কণাধর্ম”। আবার কখনও বা দুটো আলো মিলেমিশে কোথাও বেশি আলো কোথাও কম আলোর চমৎকার নকশাও (ঠিক যেমনটা ঢেউয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তেমনটা) বানাতে পারে- এটা হল “আলোর তরঙ্গধর্ম”। এককালে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন একটা তত্ত্ব দিয়েই বুঝি বা আলোর সব খেলা ব্যাখা করা যাবে। পরে ধীরে ধীরে দেখা গেল যে- আলো আসলে বলের মতও আবার ঢেউয়ের মতও। বেশি জটিল হয়ে গেল? আচ্ছা, মনে করেন এই যে আমাদের হিমু ভাই- হাড় কাঁপানো হড়ড় লেখেন, মন ছোঁয়া গল্প লেখেন, দুর্দান্ত স্যাট্যায়ার লেখেন, চমৎকার ছড়া লেখেন, কুকিলদের সাথে গানও গান। তারমানে কখনও তিনি ছড়াকার, কখনও গাতক, কখনও চিন্তক ইত্যাদি ইত্যাদি। এখণ সবগুলো গুন তাকে তো একই সাথে দেখাতে হচ্ছেনা। একেকটা, একেক দিন, একেক সময়ে প্রকাশিত হচ্ছে। যেদিন গান গাচ্ছেন ঐ মুহূর্তে ছড়াকারত্ব প্রযোজ্য হচ্ছে না, আবার ছড়া লিখলে গাতক পরিচয় খারিজও হয়ে যাচ্ছে না। আলোও ঠিক হিমু ভাইয়ের মত। যখন তার ফুটবল খেলার কথা তখন হয়ত সে “কণার মত আচরণ” করে, কিংবা যখন গান গাইতে ডাক পড়ে তখন আবার “তরঙ্গের মত আচরণ” করে।
৫।
এবার আইনস্টাইনের গল্প। ভদ্রলোক বিখ্যাত হয়েছিলেন “আপেক্ষিকতার তত্ত্ব” আর “ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার” এর জন্য। ঐ সময় সেটা দুইশ’ বছর পরে নিউটনের সারা জীবনের কাজকর্মকে প্রায় ছুঁড়েই ফেলেছিল আরকি। কিন্তু সেগুলো পরীক্ষা করে দেখার মত সূক্ষ্ম যান্ত্রিক সামর্থ্য সেই সময় ছিলনা। ১৯১০ সাল থেকে শুরু করে প্রায় এক দশক নোবেল কমিটির আলোচনার টেবিল আর ফাইলেই আটকা পড়ে ছিলেন তিনি। শেষমেশ বিজ্ঞানীরা প্রায় ধরে বেধেই তাকে নোবেল প্রাইজ দিয়ে দিলেন। তখন একজন বিজ্ঞানী, ব্রিলোঁয়া বলেই ফেলেছিলেন- “আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর, মানুষ কি ভাববে- যদি আইনস্টাইনের নাম নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় না থাকে”। অবশেষে তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯২১ সালে, সেশন জটের কারনে যা দেয়া হয় ১৯২২ সালে। তবে সে অনুষ্ঠানে আইনস্টাইন যোগ দিতে পারেননি। মজার ব্যাপার হল তিনি পুরস্কারটি পান “আলোর তড়িৎ ক্রিয়া” সংক্রান্ত একটি গবেষণা পত্রের জন্য। প্রকৃতি জুয়ো খেলুক আর নাই খেলুক, তাঁর মত মহাবিজ্ঞানীকে নিয়ে তামাশা করতে ছাড়েনি। কারন এই বিশেষ গবেষণাপত্রটির জন্য আইনস্টাইন সাহায্য নিয়েছিলেন “কোয়ান্টাম তত্ত্বের”, যা তিনি সারাজীবন মেনে নিতে পারেননি।
৬।
আলোক তড়িৎ ক্রিয়া আবিষ্কার করেন লেনার্ড নামে এক বিজ্ঞানী। আমরা তো জানিই ইলেকট্রন (যেকোনো কারনেই হোক) যখন দৌড়ের উপর থাকে তখন তাকে বলে তড়িৎ বা ইলেকট্রিসিটি; এখন, আলোর গুঁতোয় যদি ইলেকট্রন দৌড়াদৌড়ি করে তবে সেটাই হবে আলোক তড়িৎ বা ফোটো-ইলেকট্রিসিটি। [ইলেকট্রন যদি পেন্সিলের গুঁতোয় দৌড়ুত তবে তার নাম হত পেন্সিল-ইলেকট্রিসিটি।] এই আলোর গুঁতোগুঁতি নিয়ে অন্য উদ্দেশ্য গবেষণা করতে গিয়ে আরেক বিজ্ঞানী হার্জ অদ্ভুত কিছু ঘটনা দেখেন। হার্জ নামটা কি চেনা চেনা লাগে? তাঁর নাম থেকেই কিন্তু কম্পাঙ্কের এককের নাম হার্জ রাখা হয়েছে। কম্পাঙ্ক মানে হল- এক সেকেন্ডে কোন ঢেউ যতবার লাফায়, সেই সংখ্যাটা। এক সেকেন্ডে গোলাম আজম যদি ৫টা খুন করতে পারে- তবে গোলাম আজমের খৌনিক* কম্পাঙ্ক হবে ৫ হার্জ। সচলের “দৈনিক” কবিরা যদি এক সেকেন্ডে ১০টা কবিতা লিখতে পারে তবে তাদের কাব্যিক কম্পাঙ্ক হবে ১০ হার্জ, এমন। এই হল কম্পাঙ্ক আর হার্জ। মজার ব্যাপার হল হার্জ যে পরীক্ষাটা করছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আলো যে তরঙ্গধর্মী সেটা প্রমাণ করা, ঠিক সেসময় প্রকৃতি জানিয়ে দিল গল্প শেষ হয়নি। প্রকৃতি বড়ই রসিক, হিমু ভাই যেমন গল্পকে ক্লাইম্যাক্সে তুলে দিয়ে চা খেতে যান, প্রকৃতিও কখনও কখনও ঠিক তাই করে।
[ * কোণ থেকে কৌণিক হতে পারলে, খুন থেকে খৌনিক নয় কেন? ]
৭।
ধরেন, সাগরপারে লাইন ধরে কয়েকটা কোকের বোতল রাখা আছে। এমন সময় একটা ঢেউ আসলে সেগুলো একেকটা একেক দিকে ছিটকে পড়বে এটাই প্রত্যাশিত। আরো প্রত্যাশিত যে ঢেউ যত বড় হবে, ছিটকে তত বেশিদূরে যাবে- তাই তো? কিন্তু যদি তা না হয়, তখন? ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল হার্জের করা পরীক্ষায়। সাধারণ মানুষ এমন কিছুর দেখা পেলে নিশ্চয় “অলৌকিক” ভেবে পূজো করতে বসে যেত। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম, বিজ্ঞানীরা বড় ঘাড়ত্যারা, আর আইনস্টাইন তো রীতিমত গুন্ডাসর্দার। তিনি ঠিকই ভেবে বার করলেন এর ব্যাখা। অবশ্য তার আগে ম্যাক্সপ্ল্যাঙ্কের কথামত মেনে নিলেন আলো জিনিস্টা মোটেই বস্তায় রাখা আলুর মত আস্ত নয়; বরং ভাজির জন্য কুচিকুচি করা আলুর মত টুকরো করা। আসেন, এবার রূপকথার দেশ থেকে একটু ঘুরে আসি। ধরেন, সেই দেশে তিনটা সাগর আছে। প্রথমটা টিটি বলের, দ্বিতীয়টা টেনিস বলের, তৃতীয়টা ফুটবলের। এখন, কোকের বোতলগুলি তিন সাগরের পাড়ে সাজিয়ে রাখলে কি হতে পারে? টিটি বল জিনিসটা এতই হালকা পাতলা, দেখা যাবে বিশাল একটা ঢেউ ভাঙ্গলেও বোতলের কিচ্ছু হবেনা। টেনিস বলের সাগরে দেখা যাবে লড়াই প্রায় সমানে সমান- কোকের বোতল কেঁপে উঠবে, কয়েকটা কাত হবে, কিন্তু ছিটকে পড়বে না। আর ফুটবলের সাগরতীরে দেখা যাবে একেবারে পল্টনের লাঠিচার্জের মত দশা, কোন বোতল যে কোনদিকে ছিটকে পড়বে তাঁর কোন ঠিক ঠিকানা নেই। টিটি বলের সাগরে বিশাল একটা ঢেউও যেখানে কোন কাজ করতে পারেনা, ফুটবলের সাগরে ছোট্ট একরত্তি ঢেউই সেখানে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিতে সক্ষম। এবার কোকের বোতল গুলো সরিয়ে ইলেকট্রনের কথা ভাবুন। আর টিটি বলের বদলে ভাবুন অল্প কম্পাঙ্কের অর্থাৎ অল্প শক্তির আলোর কথা। টেনিস বল আর ফুটবল কেটে লিখুন মাঝারী ও বড় কম্পাঙ্ক অর্থাৎ মাঝারী ও বড় শক্তির আলো। যে আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি, তাঁর শক্তিও তত বেশি। তাই, অল্প কম্পাঙ্কের অনেকখানি আলো যা পারেনা, বেশি কম্পাঙ্কের অল্প একটু আলোই সে কাজটা খুব সহজে করে ফেলে। এই শেষ লাইনটাই ছিল আইনস্টাইনের নোবেল প্রাইজ পাওয়া গবেষণাপত্রের মূল কথা।