আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

সোমবার, আগস্ট ১৮, ২০১৪

ব্ল্যাক হোলের 'মিসিং লিংক' আবিষ্কৃত হলো !




তারার মত ভরবিশিষ্ট ছোট কৃষ্ণ বিবরগুলো আশপাশের গ্যাস নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার সময় এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়।
কিন্তু ডারহাম ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন, এখন তারা অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর (সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল) থেকেও এ ধরণের এক্স-রশ্মির সন্ধান পেয়েছেন। ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত যে অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের ভর সূর্যের তুলনায় কয়েক মিলিয়ন গুণ বেশী, সম্প্রতি সেগুলোর কাছ থেকে আসা এক্স-রশ্মি সনাক্ত করা হয়েছে।
১৭ই সেপ্টেম্বর ডারহামের গবেষক দল নেচার পত্রিকায় এই সনাক্তকরণের ফল প্রকাশ করেছেন।
গবেষকরা বলছেন, এই রশ্মির মাধ্যমে অনেক দূরের অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরগুলোর ভর পরিমাপ করা যাবে এবং তাদের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানা যাবে।
তারা ইউরোপের "নিউটন-এক্সএমএম" (Newton-XMM) মহাকাশ দুরবিন ব্যবহার করে "REJ1034+396" নামক ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এমন সময়ই এই কৃষ্ণ বিবর থেকে আসা বিস্ময়কর এক্স-রশ্মির স্পন্দন (কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন) ধরা পড়ে।
অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর
কৃষ্ণ বিবর জন্মের ইতিহাসটা প্রায় সবারই জানা। তারার সব জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, অভিকর্ষের প্রভাবে তা কেন্দ্রের দিকে ধ্বসে পড়তে থাকে। সংকোচনের কারণে তাপ বাড়তে থাকে। তাপ অনেক বেড়ে গেলে হিলিয়াম সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন ও কার্বন তৈরী শুরু করে। এর ফলে আবার ভারসাম্য ফিরে আসে। এ সময় যে বিক্রিয়া চলে তা বেশ অস্থিতিশীল। এ সময়ই বিক্রিয়ার পরিমাণ হঠাৎ খুব বেড়ে যাওয়া বা অন্যান্য কারণে তারার বহির্ভাগ আলগা হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে গ্রহ নীহারিকা তৈরী হতে পারে, আবার তীব্র বিস্ফোরণ হলে অতিনবতারাও তৈরী হতে পারে।
বহির্ভাগ চলে যাওয়ার পর কেন্দ্রে যে অবশেষ থাকে তার ভরের উপরই নির্ভর করে তারার পরবর্তী দশা। এই অবশেষের ভরও যদি সূর্যের ভরের ৩-৪ গুণ হয় তাহলে তা আবার কেন্দ্রের দিকে ধ্বসে পড়তে থাকে। কেউই তার ধ্বস ঠেকাতে পারে না। ফলে তার অভিকর্ষ বল বাড়তেই থাকে। অভিকর্ষ বল বাড়তে থাকলে একসময় কোন কিছুই তার বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না। অর্থাৎ তারার অভিকর্ষ বল কোন কিছুকেই পালাতে দেয় না, এমনকি আলোকেও না। অর্থাৎ তার মুক্তিবেগ হয় আলোর বেগের চেয়ে বেশী। আলোও আসতে পারে না বলে তাকে দেখা যায় না, এজন্যই বলে কৃষ্ণ বিবর।
এতো গেল তারার মত ভরবিশিষ্ট কৃষ্ণ বিবরের কথা। এগুলোকে ছোট বিবর বলা যায়। কিন্তু অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের ভর সূর্যের ভরের কয়েক মিলিয়ন গুণ হয়ে থাকে। এই কৃষ্ণ বিবরগুলোর উৎপত্তি বিভিন্নভাবে হতে পারে:
-
ছোট কৃষ্ণ বিবরের অভিকর্ষ বলের কারণে সবকিছু তার ভেতর ঢুকতে থাকে। এভাবে খেতে খেতে অনেক সময়ের ব্যবধানে একটি ছোট কৃষ্ণ বিবর অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হতে পারে।
-
একটিমাত্র গ্যাসীয় মেঘ থেকে অনেক অনেক তারা তৈরী হয়। এমন কোন বিশাল গ্যাসীয় মেঘের ভেতর কিছু নির্দিষ্ট ভারসাম্যহীনতার কারণে পুরোটাই একবারে কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হতে পারে।
-
ঘন তারা স্তবকে অবস্থিত সবগুলো তারা একসাথে হয়ে কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হতে পারে।
-
মহা বিস্ফোরণের পরপর যে বিপুল চাপ ছিল তার কারণে কিছু আদিম অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর তৈরী হতে পারে।
আমাদের লক্ষ্য এই অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর যাদের সাথে ছোটগুলোর বেশ কিছু পার্থক্য আছে। তবে ডারহামের গবেষণার মাধ্যমে এরকমই একটি পার্থক্য দূরীভূত হয়েছে। অর্থাৎ আমরা জানতে পেরেছি, সব কৃষ্ণ বিবরের আশপাশ থেকেই এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়। অবশ্য বড়গুলোর এক্স-রশ্মির স্পন্দনের সাথে ছোট গুলোর স্পন্দনের পার্থক্য আছে।
কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন (কিউপিও)
শুধু কৃষ্ণ বিবর না যেকোন ঘন তারার আশপাশ থেকে এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়। ঘন তারা বলতে এমন ধরণের তারাকে বোঝানো হয় যাদের আয়তন কম হলেও ভর অনেক বেশী। এর মধ্যে পড়ে, শ্বেত বামন, নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণ বিবর। ঘন তারা থেকে আমরা সাধারণ এক্স-রশ্মি ছাড়াও এক বিশেষ ধরণের এক্স-রশ্মি পাই যার নাম "কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন" (Quasi-periodic oscillation) বা "কিউপিও"। এটাই আমাদের আগ্রহের বিষয়। কারণ এর মাধ্যমেই ঘন তারার ভর নির্ণয় করা যায়। ছোট-বড় সব ধরণের কৃষ্ণ বিবরের আশপাশ থেকেই কিউপিও নিসৃত হয়, যদিও এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যে আসার আগে এক্স-রশ্মি ও কিউপিও নিয়ে কিছু বলে নেয়া প্রয়োজন।
ভিনের সরণ সূত্র অনুসারে আমরা জানি কোন বস্তু থেকে আসা সর্বোচ্চ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য তার তাপমাত্রার ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ কোন বস্তুর তাপমাত্রা যত বাড়বে তা থেকে নিসৃত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কম হবে। এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য (১০-০.১ ন্যানোমিটার) যেহেতু অনেক কম সেহেতু তা সৃষ্টি করার জন্য বস্তুর তাপমাত্রা অনেক বেশী হতে হবে। এমনকি সূর্যের তাপমাত্রাও ততোটা বেশী না। কিন্তু ঘন তারার চারপাশে মাঝে মাঝে এমন তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়।
ঘন তারা আশাপাশের গ্যাস নিজের ভেতর টেনে নেয়। গ্যসপিণ্ডের নিজস্ব ঘূর্ণন বেগ থাকার কারণে তা ঘন তারার চারপাশে ঘুরতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে যেতে থাকে। এই গ্যাসীয় পিণ্ডের সাথে ঘন তারার তলের ঘর্ষণের কারণে বিপুল তাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চ তাপমাত্রায়ই এক্স-রশ্মি নিসৃত হয়।
কিউপিও এক ধরণের এক্স রশ্মি স্পন্দন। তবে এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন:
-
কম্পাঙ্ক বনাম শক্তি লেখ আঁকলে দেখা যায়, কিছু কম্পাঙ্কে শক্তি সর্বোচ্চ মানে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ স্পন্দনে শক্তি যেমন একটিমাত্র কম্পাঙ্কে সর্বোচ্চ মানে পৌঁছায়, এখানে তেমনটি হয় না। এখানে অনেকগুলো কম্পাঙ্কের ব্যান্ডে একসাথে সর্বোচ্চ শক্তির দেখা মিলে।
-
বিকিরণের তীব্রতা নির্দিষ্ট সময় পরপর বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিকভাবে তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। শক্তির সর্বোচ্চ মানের অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই তীব্রতার এই হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
-
মোট স্পন্দনের পরিমাণ হঠাৎ করে শুরু হয় এবং এক্সপোনেনশিয়াল ভাবে কমতে থাকে।
দুর্বলভাবে চুম্বকায়িত নিউট্রন তারার মাধ্যমে কিউপিও'র এ ধরণের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা যায়। ধরি একটি গ্যাসীয় পিণ্ড নিউট্রন তারাটির চারদিকে ঘুরছে এবং ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে প্রবেশ করছে। যখনই পিণ্ডটি চৌম্বক মেরুর কাছে আসবে তখনই তার কিছু অংশ তারার ভেতর ঢুকে যাবে এবং বিপুল পরিমাণ এক্স-রশ্মি উৎপন্ন হবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর যেহেতু চৌম্বক মেরুর কাছে আসবে তাই বিকিরণের তীব্রতাও নির্দিষ্ট সময় পরপর সর্বোচ্চ মানে পৌঁছুবে। আর ঐ স্থানে পৌঁছানোর পর পিণ্ডের ভর যেহেতু কমে যাবে সেহেতু মোট স্পন্দনের পরিমাণও কমে যাবে।
কৃষ্ণ বিবরের কিউপিও
প্রথমে ছোট কৃষ্ণ বিবরের কিউপিও'র কথায় আসা যাক। কৃষ্ণ বিবর হল সর্বভুক। আশপাশের সবকিছুকে খেয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু সবকিছুরই কৌণিক বেগ থাকার কারণে সেগুলো কৃষ্ণ বিবরের চারদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে বিবরের ভেতর প্রবেশ করে। চারপাশের ঘূর্ণনশীল বস্তুগুলো যখন কৃষ্ণ বিবরের ঘটনা দিগন্তের সংস্পর্শে আসে তখনই তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই তাপমাত্রায় বস্তুগুলো বিপুল পরিমাণ এক্স-রশ্মি নিঃসরণ করতে থাকে। এই বিকিরণের তীব্রতা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর সর্বোচ্চ মানে পৌঁছে। এটাকেই কিউপিও'র পর্যায়কাল বলা যেতে পারে। ছোট কৃষ্ণ বিবরের জন্য এই পর্যায়কাল খুব ছোট, কয়েক সেকেন্ড হতে পারে।
কিন্তু অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের জন্য এই তীব্রতার পর্যায়কাল অনেক বড়, কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনও হতে পারে। এখানেই ছোটগুলোর সাথে তার পার্থক্য। এই পার্থক্যের কারণটা এরকম: ঘূর্ণায়মান বস্তু ঘটনা দিগন্ত স্পর্শ করা মাত্রই বিকিরণের তীব্রতা বেড়ে যায়। ছোট কৃষ্ণ বিবরের ঘটনা দিগন্ত বেশ ছোট ব্যাসার্ধ্যের, পাশাপাশি যে যে অঞ্চলে ঘূর্ণায়মান বস্তু বিবরের ভেতর ঢুকে সে অঞ্চলও ছোট বিবরের ক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পরপর আসে। কিন্তু বিবরের ভর যত বেশী হবে তার এ ধরণের প্রবেশমুখগুলো ততই দূরে দূরে থাকবে। এ কারণেই অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর থেকে আসা কিউপিও'র তীব্রতার পর্যায়কাল অনেক বেশী।
এই কিউপিও থেকেই বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণ বিবরের ভর নির্ণয় করেন। সম্পর্কটা তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন, কিউপিও'র কম্পাঙ্ক কৃষ্ণ বিবরের ভরের উপর নির্ভর করে। এই সম্পর্ক থেকে ভর বের করাটা খুব কঠিন না।
গুরুত্ব বিচার
এবার ডারহামের বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। তারা মহাবিশ্বের একটা বড়সড় রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি পেয়ে গেছেন। সেটা হল অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর। আমাদের আকাশগঙ্গার মত ছায়াপথের প্রায় সবগুলোর কেন্দ্রেই অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর আছে। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রেও আছে। এই বিবর এতোদিন কেবল রহস্য বাড়িয়েই গেছে। এবার তার ধরা দেবার পালা। শুধুমাত্র এই কিউপিও পর্যবেক্ষণ করে তার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে নেয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারকে ছোট ও অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরের মধ্যে একটি "মিসিং লিংক" হিসেবে বর্ণনা করছেন। এবার আরও বিস্তারিতভাবে জানা যাবে, অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবরেরা কেনো এতো পৃথক?
কৃষ্ণ বিবর মহাবিশ্বের রহস্য উন্মচনেও বিশাল ভূমিকা রাখে। এর ভেতরে কি ঘটে তা বিজ্ঞানীরা এখনও জানতে পারেননি। সে জায়গাটা যেন অজ্ঞানতার প্রতিনিধিত্ব করে। সেখান থেকে আলো আসে না, আলো ছাড়া আমরা জানতেও পারি না। আলোই এখন পর্যন্ত আমাদের জ্ঞানার্জনের প্রধান বাহন হয়ে আছে। তবে এক্স-রশ্মি আর বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে হয়ত আর আলোর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। আলো দিয়ে আর কত দেখব? এবার আলো দিয়ে অন্ধকার জয়ের পরিবর্তে অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার জয়ের পালা।
*****
ব্যবহৃত পরিভাষা
Black hole - কৃষ্ণ বিবর
Event horizon -
ঘটনা দিগন্ত
Neutron star -
নিউট্রন তারা
Quasi-periodic oscillations -
কুয়েসাই-পিরিয়ডিক স্পন্দন
Supermassive black hole -
অতিবৃহৎ কৃষ্ণ বিবর
Supernova -
অতিনবতারা
White dwarf -
শ্বেত বামন
তথ্যসূত্র:
# Scientists Find Black Hole 'Missing Link' - সায়েন্স ডেইলি
# X-ray pulse seen in biggest holes -
বিবিসি
# Super-massive and Small Black Holes Both Suck -
ইউনিভার্স টুডে

লেখকঃ শিক্ষানবিশ (সচলায়তন) 




ফার্মা'র শেষ উপপাদ্য




গণিত কাঠখোট্টা, গণিত বিরক্তিকর। কিন্তু সেই গণিতেই আছে কোমল, মায়াময় রহস্য আর টান টান শিহরণ। বলবো একটি ধাঁধার গল্প, ধাঁধাটি সরল আবার কঠিন। ঠিক যেমনটা মানুষের মন। গণিতকে ভালোবেসে মানষ পেয়েছে অমরত্ব, আবার তাকে পায়েও ঠেলেছে নিতান্ত অবহেলায়। এ গল্প তাই কেবল গাণিতিক নয়, মানবিকও।

Pierre_de_Fermat


শুরুটা হয়েছিল এভাবে।

সপ্তদশ শতাব্দীর কোনো এক স্নিগ্ধ ভোরে নিজের পড়ার ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ মোটাসোটা একটি বই পড়ছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের দ্য ফের্মা (Pierre de Fermat)বইটি গণিতের প্রাচীন গ্রীক সংকলন, 'এরিথমেটিকা'

অনেক দিন ধরেই ফের্মা বইটি পড়ছেন। এতে এত চমকপ্রদ সব গাণিতিক সমস্যা আছে যে ফের্মা প্রায় প্রতিদিন আগের চেয়ে দ্বিগণ উতসাহ নিয়ে সেগুলোর সমাধান চিন্তা করেন। প্রতিবার এক একটি সমস্যার সমাধান খুঁজে পান, আর ভাবেন, আহ্ এর চেয়ে সুখ আর কি হতে পারে জীবনে, জগতের সবচেয়ে ধ্রুব সত্য গণিতের সেবা করতে পেরে ফের্মার মন দ্রবীভূত হয়ে যায়। বই থেকে চোখ তুলে প্রতিবার সামনে তাকান, সে চোখে থাকে আনন্দের তৃপ্তি, চিকচিক করে সত্যের প্রতি প্রার্থনার জল। তারপর লিখে রাখেন সদ্য আবিষ্কৃত গণিতের কোনো চিরন্তন প্রমাণ কিংবা কোনো গাণিতিক সমস্যার কথা, যাদের অনেকগুলোই পরবর্তী অজস্র গণিতবিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের এবং আনন্দের কারণ হয়ে থাকবে।

তারপরই প্রতিবার বিষন্নতা ভর করে জগতবিখ্যাত গণিতবিদ পিয়ের দ্য ফের্মার মনে।

এরকমই এক বিষন্ন সকালের একটু একটু করে ফুটে উঠা আলোয় ফের্মা একটি অসাধারণ সুন্দর কিন্তু বিদঘুটে সমস্যা নিয়ে ভাবছিলেন।

ভাবতে ভাবতে একসময় মুচকি হাসলেন ফের্মা। তারপর কলমদানি থেকে চমতকার কারকার্যখচিত একটি কলম তুলে কালির দোয়াতে চুবালেন। অভিজাত ফরাসি কায়দায় দোয়াতে কলমের গায়ে লেগে থাকা অতিরিক্ত কালিটুকু মুছে নিয়ে বইয়ের মারজিনের ফাঁকা অংশটায় লিখলেন,
'এই সমস্যার অসম্ভব সুন্দর একটি প্রমাণ আমার কাছে আছে। কিন্তু এই মার্জিনে সেটি আটবে না।'

গণিতের ইতিহাসে এত বড় ক্রুর রসিকতা বোধহয় আর কেউ করেন নি। কে জানতো পরবর্তী সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফের্মার সেই অসম্ভব সুন্দর প্রমাণের পেছনে সবাইকে ছুটতে হবে!

ফের্মা বইয়ের মার্জিনে যে সমস্যাটার কথা লিখেছিলেন সেটা এত সহজ যে দশ বছরের যে ছেলেটি স্কুলে গণিত শিখে সেও বুঝতে পারবে,কিন্তু তা প্রমাণ করতে বাঘা বাঘা গণিতজ্ঞদের ঘাম ছুটে যাবে। আদতে সেই সময় কারোরই যে প্রমাণটা জানা ছিল না, তা বলাই বাহুল্য।

ফের্মা'র শেষ উপপাদ্য

আমরা সবাই পীথাগোরাসের উপপাদ্যের কথা জানি।
  
দারুণ আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই উপপাদ্য বলে যে অনেক ত্রিভুজই আমরা গড়তে পারবো যাদের প্রতিটি বাহু হবে পূর্ণসংখ্যা। অন্য কথায়, সংখ্যার জগতে এরকম তিনটি সংখ্যার অনেক সুখী পরিবারই পাওয়া যাবে যেখানে কনিষ্ঠ দুই পূর্ণসংখ্যার প্রতিটির বর্গের সমষ্টি তৃতীয়জনের বর্গের সমান। উদাহরণ,

কিন্তু ফের্মা বললেন যে সেটা ঠিক আছে, ঠিক থাকবে যদি আমরা কেবল সংখ্যাগুলোর বর্গ নেই। ঘন কিংবা তার বেশি সূচক নিলে এই নিয়ম ভেঙ্গে পড়বে। তার মানে, আমরা কখনোই এমন তিনটি পূর্ণসংখ্যা পাবো না যারা নিচের সমীকরণটি মেনে চলবে, যদি n এর মান তিন বা তার চেয়ে বেশি হয়!
  
উপপাদ্যটি এত সহজ যে, কারো বুঝতে তেমন কষ্ট হবার কথা নয়, কিন্তু গণিতবিদরা তো কেবল তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন না, তাদের দরকার গণিত দিয়েই প্রমাণ করা যে ফের্মার এই উপপাদ্যটি আদতেই সঠিক।

বিপত্তিটা ঘটলো সেখানেই।

উপপাদ্যটির কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারছিলেন না। আবার কেউ এমন কোনো উদাহরণও দিতে পারছিলেন না যে, ফের্মার উপপাদ্যটি ভুল।

এর মধ্যে আবার স্বয়ং ফের্মার এমন হেয়ালি! আরে বাবা, যদি জানাই থাকে তাহলে বলে ফেললেই হয়, তা না। রহস্য।

ফের্মার জীবিতাবস্থায় বইয়ের মার্জিনে লেখা সেই অবিষ্মরণীয় দুটি লাইন কারো নজরে আসে নি, ফের্মা নিজেও উপপাদ্যটির কোনো প্রমাণ আর দিয়ে যান নি। মূলত ফের্মার মৃত্যর পর তাঁর ছেলে যখন মার্জিনে লেখা নোটগুলো বই আকারে ছাঁপেন, তখনই সবাই রহস্যটির কথা জানতে পারে।


সেই থেকে বাঘা বাঘা পন্ডিত হয়রান,কিন্তু যে লাউ সেই কদু। গণিত হয়ে থাকলো রহস্যময়, তার চেয়েও রহস্যময় ফের্মার সেই উক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত না উনিশশো পচানব্বই সালে এন্ড্রু ওয়াইলস এসে বললেন, আমার মনে হয়, প্রমাণটা আমি পেয়ে গেছি!


লেখকঃ ফারুক হাসান (সচলায়তন) 

সংলাপ: মহাবিশ্ব সসীম না অসীম?




ইতিহাসের সেরা ছাত্র-শিক্ষক জুটি হলেন প্লেটো-সক্রেটিস, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ খুবই কম। সক্রেটিস মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন আর প্লেটো সক্রেটিসের শিক্ষাকে সংরক্ষণ করেছে সংলাপের মাধ্যমে। "প্লেটোর সংলাপ" নামে পরিচিত এই সাহিত্যভাণ্ডার মানবতার জন্য অনেক কিছু। পড়লেই বোঝা যায় কত সূক্ষ্ণভাবে চিন্তা করতেন সক্রেটিস আর কত সূক্ষ্ণভাবে তা অনুসরণ করতো প্লেটো।

বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের। কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি দর্শনের প্রয়োজনীয়তা। জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের দর্শন। দর্শন বলতে আসলে প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসাকে বোঝায়। এই ভালোবাসা নিঃশর্ত, সেখানে আত্মপ্রত্যয় থাকলেও আত্মম্ভরিতা নেই। দর্শনানুরাগীরা শিশুর মত বিস্মিত হতে জানে, এ এমন এক বিস্ময় যা থেকে হাজারটা প্রশ্নের জন্ম হয়। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই প্রজ্ঞার সন্ধান পেয়ে যায় তারা।
বাস্তব জীবনেও দেখা যায়, যেকোন বিষয় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তুলে ধরলে বোঝা যায় বেশী। বিজ্ঞানের জগতেও এই সূত্র খাটে। এজন্যই বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সাইটে "ফ্রিকোয়েন্টলি আস্ক্‌ড কোয়েশ্চেন" (ফ্যাক) এর সমাহার দেখা যায়। বিজ্ঞানের মজার বিষয়গুলোকে আমি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই। তবে এগুলোকে ফ্যাক বলবো না। ফ্যাক বিষয়টা অনেক হালকা ও রসহীন।
আমি বরং প্লেটোর সংলাপের আদলে বিজ্ঞান সংলাপ শুরু করছি। এজন্য প্রাথমিকভাবে দু'টি চরিত্র ঠিক করেছি, একজন শিক্ষক আরেকজন ছাত্র। শিক্ষকের নাম দিয়েছি সক্রেটিস, আর ছাত্রের নাম প্লেটো। ভবিষ্যতে আরও চরিত্র আসতে পারে। তবে আপাতত এই দু'জনই কাজ চালিয়ে নেবে। আলোচনা দর্শনকেন্দ্রিক না হয়ে বিজ্ঞানকেন্দ্রিক হবে। সক্রেটিস একেবারে সঠিক উত্তর দেবেন, প্লেটো সবসময়ই চাইবে দর্শনকেন্দ্রিক হয়ে পড়তে। তাকে দর্শনমুখীনতা থেকে ফিরিয়ে বিজ্ঞানমুখী করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
এটাকে কিন্তু নাটক বলা যাবে না। নাটক লেখার সাধ্যি আমার নাই। এটা দুই চরিত্রের সংলাপ কেবল। কোন কাহিনী বা অনুষঙ্গ নাই। উদ্দেশ্য শুধুই প্রকৃতির নিয়ম অনুসন্ধান।
আরেকটা বিষয়, সংলাপের প্রতিটি পর্বই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, ধারাবাহিক কিছু না। তাই আগেরটা না পড়লেও পরেরটা পড়তে বাঁধা নেই।
আমাদের যুগের সক্রেটিস-প্লেটো মহাবিশ্ব সসীম নাকি অসীম, এই নিয়ে তাদের সংলাপ শুরু করছে।
সক্রেটিস: এখন পর্যন্ত দেখা মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী বস্তু হল "অ্যাবেল ১৮৩৫ আইআর১৯১৬" নামক ছায়াপথ। "ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি" থেকে এটা আবিষ্কার করা হয়েছে। অ্যাবেলের দূরত্ব ১৩.২৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। অর্থাৎ অ্যাবেলকে আমরা ১৩.২৩ বিলিয়ন বছর আগের অবস্থায় দেখছি। এতো দূর, তারপরেও যেন নগণ্য। কারণ এতো দূর দেখেও কোন সীমার সন্ধান পাইনি আমরা। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ভিত্তিতে বলতেই হয়, মহাবিশ্ব অসীম।
প্লেটো: কিন্তু পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষণের বাইরেও তো একটা বিজ্ঞান রয়ে গেছে। সে বিজ্ঞানের নাম গণিত। গণিত দিয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসা কি সম্ভব হয়েছে?
সক্রেটিস: সসীম-অসীমের এ প্রশ্নে গণিত না এনে উপায় নেই। প্রশ্নটা চমৎকার। তবে গণিতকে কেউ প্রমাণ হিসেবে নেয় না। আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা গণিত দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন বলেই প্রথমটায় সাড়া পেয়েছেন কম। কিন্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমীকরণের পক্ষে দলিল পাবার পর এর থেকে গুরুত্ববহ আর কিছু ছিল না।
প্লেটো: বর্তমানে বিজ্ঞান যেহেতু আমাদের পর্যবেক্ষণকে ছাড়িয়ে গেছে, সেহেতু গণিতের কাছে ফিরে আসতেই হয়। গণিত কি এতোদিনে সমস্যাটার সমাধান করে ফেলেনি?
সক্রেটিস: আবারও গণিতের কাছে ফিরে আসার জন্য সাধুবাদ। শুধু এই যুগ না, সব যুগেই বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের থেকে এগিয়ে ছিল। গণিতের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, গণিত যায় আগে, তার পিছে পিছে যায় পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞান। সসীম-অসীম প্রশ্নে গণিতের নির্দিষ্ট অবস্থান আছে। তবে সেটা বোঝার আগে মেনে নিতে হবে, ফ্রেড হয়েলের স্থিতিশীল মহাবিশ্বের তত্ত্ব ভুল। এটা মেনে নেয়ার অর্থই মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রসারণের সাথে অসীমের সম্পর্ক নেই। কিন্তু সম্প্রসারণ মেনে নিলে অসীম বোঝাতে সুবিধা হয়। হ্যা, আপেক্ষিকতাভিত্তিক গণিত বলছে, মহাবিশ্ব অসীম।
প্লেটো: আপেক্ষিকতাভিত্তিক গণিতের এই বিষয়টা তো এখন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে চলে গেছে। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের গবেষক সম্প্রদায়ই কি দায়িত্বটা নিচ্ছেন?
সক্রেটিস: জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানকে আরও সরু করে বিশ্বতত্ত্বের উৎপত্তি ঘটেছে। এটা এখন বিশ্বতত্ত্বের অংশ। ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বের বিপরীতে কাজ করে এই বিশ্বতত্ত্ব। বিশ্বতত্ত্ব মহা বিস্ফোরণের ঠিক আগ মুহূর্তও অসীম দিয়ে ব্যাখ্যা করে।
প্লেটো: তাহলে, অসীম মহাবিশ্বের ধারণাটা ঠিক কেমন? বিশ্বতত্ত্ব মহা বিস্ফোরণ দিয়ে কিভাবে অসীমকে ব্যাখ্যা করে?
সক্রেটিস: তাহলে মহা বিস্ফোরণ থেকেই শুরু করতে হয়। একটা অসীম ঘনত্ব ও শূন্য আয়তনের বিন্দুর মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটার ঠিক ১০টু দ্য পাওয়ার-৪৫ সেকেন্ড পর স্থান-কালের সৃষ্টি হয়েছে।
প্লেটো: যে বিন্দুটা বিস্ফোরিত হয়েছে সেটা কোথায় ছিল?
সক্রেটিস: অসীম ঘনত্বের বিন্দুটা বিস্ফোরিত হয়েই কিন্তু অসীম মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। আদি বিন্দুটাও অসীমের মধ্যে ছিল। বিস্ফোরণের বিষয়টা এমন না যে, একটি বিন্দু থেকে সবকিছু ছড়িয়ে পড়ছে। বিস্ফোরণের আগে পড়ে সবসময়ই অসীমতাকে দখল করে ছিল সে। এ কারণে মহাবিশ্ব সব দিক থেকে সমভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ কারণেই বর্তমান মহাবিশ্ব সমসত্ব। অর্থাৎ সকল বিন্দু থেকেই মহাবিশ্বকে দেখতে একরকম লাগে।
প্লেটো: কিন্তু, অসীম একটা জিনিস আরেকটা অসীমের মধ্যে থাকে কি করে?
সক্রেটিস: এখানেই বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে প্যারাডক্স তথা হেঁয়ালির সূচনা। তবে এই হেঁয়ালির পেছনেও যুক্তি আছে। হিলবার্টের অসীম কক্ষবিশিষ্ট হোটেলের হেঁয়ালি দিয়ে অসীমতাকে ব্যাখ্যা করা যায়। এটা অসীম হেঁয়ালি নামেও পরিচিত।
প্লেটো: অসীম হেঁয়ালি কি অসীমের মধ্যে সবকিছুকে গ্রহণ করে নেয়ার মত কোন গোঁড়া কিছু?
সক্রেটিস: গোঁড়াই বলতে হবে। কিন্তু একটা সাধারণ বাখ্যা আছে এর পেছনে: দুটি হোটেল কল্পনা কর যার একটিতে কক্ষ সংখ্যা সসীম এবং অন্যটিতে অসীম। ধরা যাক, দুটি হোটেলের সব রুমই বুক হয়ে গেছে। সসীম কক্ষের হোটেলে নতুন কেউ আসলে ম্যানেজার তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু অসীম কক্ষের হোটেলে কেউ আসলে সানন্দে জায়গা করে দেবেন ম্যানেজার।
প্লেটো: এটা কিন্তু সাধারণ ব্যাখ্যা হল না। অসীম সবকিছু নিতে পারে অনেকটা তেমনই।
সক্রেটিস: সাধারণ ব্যাখ্যাটা প্রক্রিয়া নিয়ে। কিভাবে অন্যদেরকে জায়গা করে দিবেন অসীম কক্ষের হোটেলের ম্যানেজার? প্রক্রিয়াটা হল তিনি ১ম কক্ষের জনকে দ্বিতীয় কক্ষে পাঠিয়ে দেবেন, দ্বিতীয় কক্ষের জনকে তৃতীয়টিতে, তৃতীয়র জনকে চতুর্থটিতে এবং এভাবে সবগুলো। এভাবে প্রথম কক্ষটি খালি হয়ে যাবে।
প্লেটো: অসীম কক্ষবিশিষ্ট কোন হোটেলে যদি অসীম সংখ্যাক নতুন পর্যটক এসে উপস্থিত হয়, তখন কি করবেন?
সক্রেটিস: ম্যানেজার প্রথম কক্ষের লোককে তৃতীয় কক্ষে পাঠিয়ে দেবেন, দ্বিতীয় কক্ষের লোককে চতুর্থ কক্ষে, তৃতীয় কক্ষের লোককে ষষ্ঠ কক্ষে এবং এভাবে পাঠাতে থাকবেন। স্পষ্টতই বিজোড় কক্ষগুলো খালি হয়ে যাবে। অসীম স্থানান্তরের কারণে অসীম সংখ্যাক বিজোড় কক্ষ খালি হবে, সেখানে অসীম সংখ্যক নতুন পর্যটক জায়গা পেয়ে যাবেন।
প্লেটো: হিলবার্টের হেঁয়ালিটা আসলেই বিভ্রান্তিকর। কিন্তু যুক্তির খাতিরে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তবে আমার মনে হচ্ছে, অসীম নিয়ে আলোচনায় সমাধানের থেকে প্রশ্ন উঠে আসে বেশী।
সক্রেটিস: এর কারণ আমাদের অজ্ঞতা। এক সময় মানুষ কিছু না বুঝলে সেখানে ঈশ্বরকে স্থাপন করতো। এখন বিজ্ঞজনেরা তা করতে চাচ্ছে না। অসীম তাই অনেক কিছুর সমাধান দিচ্ছে। যদিও সেটা এখনও হেঁয়ালির পর্যায়ে।
প্লেটো: অনেকে বলেন একটি অসংজ্ঞায়িত বিন্দু থেকে সম্পূর্ণ নতুন মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়নি। বরং আগের মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে শূন্যে বিলীন হয়ে যাবার আগে এমন কিছু ঘটেছিল যার কারণে শূন্যে বিলীন না হয়ে নতুন আরেকটি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই তত্ত্বের সাথে কি বিশ্বতত্ত্বের সাযুজ্য আছে?
সক্রেটিস: বর্তমান মহাবিশ্বের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এটা আদৌ সংকুচিত হবে না। প্রসারিত হতে হতে একসময় সব শক্তির উৎস নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাহলে সংকোচনের ব্যাপারটা আসে না। অবশ্য গণিতে একটি ধ্রুবক আছে যার মান পরিবর্তন করে মহাবিশ্বকে সংকুচিত করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সংকোচন হতেও পারে। আর সংকোচন হলে শূন্যে আসার আগে আবার প্রসারণও শুরু হতে পারে। এভাবে স্পন্দনশীল মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। তাতেও কোন সমস্যা নেই। অসীমের মধ্যেই স্পন্দনশীল অসীম মহাবিশ্বের বিবর্তন ঘটবে।
প্লেটো: আর বহুবিশ্বের ধারণার কি হবে?
সক্রেটিস: হ্যা, অনেকে বলছেন মহা বিস্ফোরণ হল কৃষ্ণ বিবরের উল্টো। কৃষ্ণ বিবর সবকিছু নিজের মধ্যে নিয়ে নেয়। আর মহা বিস্ফোরণ সবকিছুকে নিজের ভেতর থেকে বের করে দেয়। তাহলে অসীম সংখ্যক মহা বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে, যেমন অনেক অনেক কৃষ্ণ বিবর আছে। এক্ষেত্রেও সমস্যা নাই। হিলবার্ট বলেন, অসীমের মধ্যে অসীম সংখ্যক অসীম মহাবিশ্ব থাকতেই পারে।
প্লেটো: তাহলে অসীমকেই মেনে নিলাম। কারণ বিশ্বতাত্ত্বিক গবেষণার মূলধারা অসীমকে ঘিরেই। কেউ প্রথাবিরোধী হতে চাইলে সসীম নিয়েও নতুন মাত্রায় কাজ শুরু করতে পারে। বিজ্ঞান আমাদেরকে সে সুযোগ করে দিয়েছে।

লেখাটা "সচলায়তন" থেকে নেয়া। লিখেছেন শিক্ষানবিশ।



বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৪, ২০১৪

সময় পরিভ্রমন করা কি আদৌ সম্ভব !!?




সময় পরিভ্রমণ কি সম্ভব? সায়েন্স ফিকশনগুলোতে সময় পরিভ্রমণ করে অতীত বা ভবিষৎতে যাওয়া-আসা দেখানো হয়। সুতরাং খুব বাড়াবাড়ি রকম সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত ছাড়া সবাই বলবে যে, না, সময় পরিভ্রমণ সম্ভব নয়। তবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান কিন্তু একধরণের সময় পরিভ্রমণের কথা স্বীকার করে। আইনস্টাইনের থিওরী অব রিলেটিভিটি থেকে আমরা জানি, কোন নভোচারী যদি দূরবর্তী কোন গ্রহ বা নক্ষত্রে আলোর কাছাকাছি কোন বেগে ভ্রমণ করে তাহলে সে একশো বছরের ভবিষ্যতেও যেতে পারবে। কারণ এই প্রক্রিয়ায় তার মাত্র কয়েক বছর ব্যয় হবে। সুতরাং না হয় ধরেই নেয়া হলো যে, ভবিষ্যৎ সময়ে এভাবে পাড়ি দেয়া সম্ভব, কিন্তু অতীতে? , যা আপাতত দৃষ্টিতে অসম্ভব। ধরুন, আপনার জন্ম ১৯৬০ সালে। এখন যদি আপনি সময় পরিভ্রমণ করে ১৯০০ সালে যেতে চান সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে? কারণ, সেই সময় তো আপনি জন্মগ্রহণই করেননি। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেয়া হয় যে, আপনি সময় পরিভ্রমণ করে আপনার শৈশবে ফিরে গেছেন, তবুও এটা ধরে নেয়া অবশ্যই যুক্তিযুক্ত হবে না যে, সময় পরিভ্রমণ করে আপনার জন্মের আগের সময়েও আপনি যেতে পারবেন।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলোতে এ ধরণের ঘটনা দেখানো হয়
এ ধরণের প্যারাডক্স এড়ানোর জন্য দুটি বিকল্প কথা চিন্তা করা যায়। একধরণের সামাধানে বলা হয় যে, অতীত সময় পরিভ্রমণকারীরা নতুন একধরণের টাইমলাইন সৃষ্টি করবে। যেটা প্রকৃত ঘটনা, যেটা ঘটেছে সেটার সমান্তরাল কিন্তু স্বাত্বন্ত্র্যপূর্ণ হবে।
যেমন ধরে নেয়া হলো, টাইম মেশিনের আবিস্কারক অতীত সময় পরিভ্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির গুপ্তহত্যা প্রতিরোধ করতে চাইল। সে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে কোন একদিন টাইম মেশিনে রওনা হলো এবং ১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বর (কেনেডির মৃত্যুদিন) সকালের ডালাসে পৌছাল, সকালের সংবাদপত্র সেদিনকার তারিখ নিশ্চিত করছে। শহরের সবাই কেনেডিকে উঞ্চ অভিনন্দন দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে এরকম অনেক কিছু। কিন্তু প্যারাডক্সের সমাধান মতে এটা অরিজিনাল ১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বর নয়, যেদিনের ইতিহাস বইয়ে আছে অথবা প্রবীনদের মস্তিষ্কে আছে। অরিজিনাল ২২শে নভেম্বর ১৯৬৩ সালে আমাদের ভ্রমণকারী যেখানে ছিল না, সে সেদিনকার সংবাদপত্রের কপিও কেনেডি অথবা কেনেডির হত্যাকারী অসওয়ার্ল্ডকে দেখে সন্দেহ করেনি। তার এই সকাল পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও ছিল না। তাহলে ভ্রমণকারী প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৩ এর ২২শে নভেম্বর যায়নি। সুতরাং এক্ষেত্রে কেনইবা দাবী করা হবে যে ঐ সময়ে গিয়েছিল। এটার সমাধান হলো আসলে সময় পরিভ্রমণকারী যেখানে যাবে সেটা একটা সমান্তরাল বিশ্ব, যেখানে পৃথিবীর  সমান্তরাল কিছু ঘটনাই অথবা ধরা যাক প্রকৃতপক্ষে এখানে যা ঘটেছে সেটাই ঘটেছে।
সময় পরিভ্রমণ প্যারাডক্স সমাধানের দ্বিতীয় পন্থায় ধরে নেয়া হয় যে, পরিভ্রমণকারী ঐ সময়ে পরিভ্রমণ করবে ঠিকই কিন্তু ঘটনার কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। অর্থাৎ ধরে নেয়া হলো যে, পরিভ্রমণকারী ১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বরে পৌঁছল ঠিকই, সংবাদপত্র কিনে সেদিনের তারিখ দেখে নিশ্চিতও হলো, এমনকি কেনেডির গুপ্তহত্যা ঠেকাতে চেষ্টাও করল কিন্তু পারল না। অথবা অসওয়ার্ল্ডকে গুলি করা থেকে নিবৃত্তও করল কিন্তু ধরে নেয়া হলো যে, সেখানে আরো গানম্যান ছিল যাদের সে রুখতে পারল না। অর্থাৎ সময় পরিভ্রমণকারীরা অতীত সময়ে যেতে পারল ঠিকই কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বা ইতিহাসের কোন পরিবর্তন করতে পারল না। এধরণের সময় পরিভ্রমণ যৌক্তিকভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটা ফিজিকালী বা শারীরীকভাবে সম্ভব হবে। কারণ, হিসেব করে দেখা গেছে যে, একাজে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হবে সেটা প্রকৃত অর্থেই অকল্পনীয় এবং প্রকৃতি সে পরিমাণ শক্তিকে সমর্থনও করে না।
আবার একটি যুক্তি দিয়ে অনেকে দেখিয়ে দেন যে, সময় পরিভ্রমণ বাস্তবে কখনও সম্ভব নয়। যদি ধরেই নেয়া হয় বর্তমান প্রযুক্তিগত অসুবিধার কারণে শারীরীকভাবে সময় পরিভ্রমণ করতে যে পরিমাণ শক্তি দরকার তা পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু এটা তো অন্তত ধরে নেয়া যাবে যে ভবিষৎতে প্রযুক্তিগত আরো উৎকর্ষ সাধন হলে এ পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষরা সময় পরিভ্রমণ করতে পারবে। সুতরাং অবশ্যই তারা অতীত পৃথিবী ভ্রমণ করতে চাইবে। কিন্তু আমরা কি আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এরকম কোন অতীত সময় পরিভ্রমণকারী দেখতে পাই? সুতরাং হাজার হাজার বছর পরের উন্নত প্রযুক্তির পৃথিবীর মানুষই যদি সময় পরিভ্রমণ করে আমাদের এ সময় বা আগেকার কোন সময়ে আসতে পারেনি, তাহলে কেনইবা আমরা সময় পরিভ্রমণের ব্যাখ্যা মেনে নেব? সুতরাং ওয়েলসের টাইম মেশিন নিয়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়ে সেগুলোকে আগামী দিনের ঘটনা মনে হওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ কি মেনে নেয়া উচত হবে?

লেখাটা "সচলায়তন" থেকে নেয়া