আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৩, ২০১৪

রহস্যময় ফোটনের জগত--হচ্ছে আর ঘনীভূত

আলো কি তরঙ্গ নাকি কণা- এই বিতর্ক বহুদিনের । তরঙ্গ তত্ত্ব বা কণা তত্ত্ব দুটিই পৃথকভাবে আলোর কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারলেও সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এদের কোনটাই পুরোপুরি সফল না। আলোর ধর্মগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে নানা বিজ্ঞানী নানা সময় নানারকমের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন । সব তত্ত্ব থেকে শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্তেও আসেন তারা যে আলো একইসাথে কণা ধর্মী ও তরঙ্গ ধর্মী । আইনস্টাইনের আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব আলোর ক্ষেত্রে কোয়ান্টা তথা ফোটন নামের এক নতুন ধারনার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, তাও আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগে । এর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বের উপর অন্যভাবে বলতে গেলে ফোটনের উপর , ফোটনের নানা বৈশিষ্ট্য আর এর উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা হয়ে এসেছে এবং হচ্ছে । এই গবেষণারই সর্বশেষ আবিষ্কার আলোক অণু । 

প্রথমে ফোটন নিয়ে একটু কথা বলা যাক । ফোটন বা কোয়ান্টা হল আলোর খুব ক্ষুদ্র গুচ্ছ, যার স্থির ভর (Rest mass) শুন্য । প্রত্যেক ফোটন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের শক্তি ধারন করে যাকে E= hv দিয়ে প্রকাশ করা যায় । এই শক্তির কারণে কোন ধাতুর উপর পর্যাপ্ত কম্পাঙ্কের আলো পড়লে এই কোয়ান্টার শক্তি ইলেকট্রনে সঞ্চারিত হয়ে ধাতুপৃষ্ঠ থেকে তাদেরকে মুক্ত করে দেয় । এই ঘটনাকে বলা হয় আলোর তড়িৎক্রিয়া । মূলত আলোর তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা করতে গিয়েই ফোটন নিয়ে বিজ্ঞানিরা প্রথম আগ্রহী হয়ে ওঠেন । 

এখন প্রশ্ন হল ফোটন নাহয় বুঝলাম কিন্তু আলোক অণু ! এটা আবার কি? এটা খুব মৌলিক একটা প্রশ্ন উত্তরটাও আপেক্ষিক ভাবে মৌলিক ই বলা চলে । অণু বলতে আমরা কি বুঝি? খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে অণু হল এক বা একাধিক পরমানুর একটি গুচ্ছ । ফোটনকে আমরা একক ভাবে একটা কণা বলতে পারি, যখন একাধিক ফোটন সময়ের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের জন্য ও অণুর মত একসাথে গুচ্ছ তৈরি করে তখন এই যুগ্ম অবস্থাটাকেই বলা হয় আলোক অণু । এখন কথা হল কেন এই আলোকঅণু । এই প্রশ্নের উত্তর একটু পরেই দিচ্ছি , তার আগে আলোকঅণুর আবিষ্কার নিয়ে একটু জেনে আসা যাক ।

এই পরীক্ষণ দলের নেতৃত্বে ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মিখাইল লুকিন এবং এম.আই.টি র ভ্লাদান ভুলেকটিকাট । তারা রুবিডিয়ামের Ultracold atomic gas ( রুবিডিয়াম পরমাণু সমন্বয়ে গঠিত গ্যাস যার তাপমাত্রা পরমশুন্য তাপমাত্রা তথা 0 কেলভিন এর খুব নিকটবর্তী । ফোটনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় নীল বর্ণের লেজার রশ্মি যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল ৪৭৯ ন্যানোমিটার । তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই বিশেষ মান আর এই পরীক্ষণে কেন রুবিডিয়াম ব্যবহার হল তা একটু পরেই বলছি । এই পরীক্ষণে বিজ্ঞানিরা দুটো ফোটনকে নির্দিষ্ট মানে পোলারাইজড ( Polarization- মেরুকরণ ) করে রুবিডিয়াম পরমাণু সমৃদ্ধ গ্যাসে নিক্ষেপ করেন এবং এই ফোটন কণা গুলোর একসাথে দৃশ্যমান হবার সময়ের পার্থক্য নির্ণয় করেন – সংক্ষেপে এটাই ছিল এই পরীক্ষণের উপসংহার। এবার পরীক্ষণটি ব্যাখা করা যাক ।

প্রথমেই রুবিডিয়াম আর ৪৭৯ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিষয়টা ব্যাখা করি । রুবিডিয়ামের পারমানবিক সংখ্যা ৩৭ , একটি দুর্লভ ,নরম ক্ষারধাতু । ৪৭৯ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল বর্ণের লেজার যখন রুবিডিয়াম গ্যাসের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হয় তখন রিডবার্গের অবস্থা ( Rydberg State) নামক একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় । এখন প্রশ্ন হল এই Rydberg State কি । Rydberg State বলতে মূলত একটি পরমাণুর একটি উত্তেজিত অবস্থাকে বোঝান হয় যখন তার একটি ইলেকট্রন পরমাণুটি থেকে মুক্ত হবার জন্যে যথেষ্ট শক্তির অধিকারী হয় , এই অবস্থায় ইলেকট্রনটি আবার আশেপাশের আরও কয়েকটি পরমাণু শেয়ার করে । কোন সিস্টেমে একটি Rydberg State সৃষ্টি হলে তা ওই নির্দিষ্ট পরমাণুর কাছাকাছি আর কোন Rydberg State সৃষ্টি হতে দেয়না । একে Rydberg Blockade । যাই হোক এখন দুটি কথা সহজে বলা যায় – 

প্রথমত , দুটি ফোটনের মধ্যে যেকোনো একটিই Rydberg State এ যাবে অন্যটি যাবে না।
দ্বিতীয়ত, যে ফোটনটি Rydberg State অর্জন করবে , আশেপাশের রুবিডিয়াম পরমাণুর সাথে শেয়ার হবার কারণে তার গতি কিছুটা কমে যাবে , যা অপর ফোটনটির ক্ষেত্রে ঘটবে না । 
রুবিডিয়াম এর ক্ষেত্রে এই বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল লেজার নিঃসরিত ফোটন থেকেই এই দুটি অবস্থা পাওয়া যায়। 

এবার প্রশ্ন হল এই পরীক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা কিভাবে আলোকঅণু সৃষ্টির ব্যাপারটি নিশ্চিত হলেন। এটা বুঝতে হলে আমাদের এই পরীক্ষার পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য গুলো দেখতে হবে। আগেই একটি কথা বলেছি পরীক্ষায় দুটি ফোটনের মধ্যে একটি Rydberg State অর্জন করে ফলে এর বেগ অপেক্ষাকৃত কমে যায় । তাহলে সাধারণ ভাবেই আমরা ধরে নিতে পারি অপর ফোটনটি এই কম গতির ফোটনকে অতিক্রম করে চলে যাবে , এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত ফোটনের একটি ধর্ম হল সাধারণ অবস্থায় দুইটি ফোটন নিজেদের মধ্যে কোন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখায় না, একটি অপরটির মধ্য দিয়ে কোন পরিবর্তন না ঘটিয়েই চলে যেতে পারে । যদিও প্রত্যেকটি ফোটনেরই নিজস্ব তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে কিন্তু বিশেষ অবস্থা ছাড়া অন্য কোন ফোটনের উপর এই ক্ষেত্রের প্রভাব খুবই নগণ্য । যাই হোক দ্বিতীয় ফোটনটি প্রথম ফোটনকে অতিক্রম করে যাবার কথা থাকলেও এটা হয়না আর একটি ঘটনার কারণে যাকে আমরা প্রতিসরণ বলে জানি । Rydberg State এ থাকা ফোটন এবং এর আশেপাশের এলাকাতে এই State এর কারণে প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন হয় । আর এজন্যে দ্বিতীয় ফোটনটি অতিক্রম করে না গিয়ে প্রথম ফোটনটির আরও কাছে চলে আসে । এই ঘনিষ্ঠ অবস্থানের কারণে তাদের মধ্যেQuantum Entanglement এর সৃষ্টি হয় ( Entangle মানে জড়িয়ে পড়া, Quantum Entanglement বলতে দুটি কণার এমন ঘনিষ্ঠ অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একটি কণার সাপেক্ষে অন্য কণাটির বৈশিষ্ট্য ব্যাখা করা যায় )। এ কারণে এই দুটো ফোটন এই রুবিডিয়াম গ্যাসের এই সিস্টেম থেকে আলাদা দুটো ফোটন হিসেবে বের না হয়ে একসাথে একটি কণার আকারে আবির্ভূত হয় । এটা থেকে এই ব্যাপারে ধারণা করে নেওয়া যায় যে ওই কয়েকটি মুহূর্তের জন্যে ফোটন দুটোর মাঝে পারস্পরিক আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল অর্থাৎ এরা অণু আকারেই ছিল। এই Quantum Entanglement এর ব্যাপারটি নিশ্চিত হবার জন্যেই বিজ্ঞানীরা ফোটন দুটিকে নির্দিষ্ট Polarization এ নিক্ষেপ করেন । সময়ের সাথে এই ফোটনগুলোর Polarization এ পরিবর্তন হয়। ফোটন গুলোর Polarization এর আপেক্ষিক সম্পর্ক থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ফোটনদুটো যখন অণু গঠন করেছিল তখন তারা Entangled ছিল । এভাবেই প্রথমবারের মত গবেষকরা সফলভাবে আলোকঅণুর অস্তিত্ব প্রমাণ করেন । 

এটা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, অন্যভাবে বলতে গেলে একটি বড় অর্জনের সূচনামাত্র । কারণ ফোটনের এই জগত সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই আমাদের অজানা । সত্যি বলতে আলোকঅণুর এই আবিষ্কার ব্যবহারিক ঠিক কোন ক্ষেত্রে লাগবে তা নিয়ে কারো ই সঠিক ধারণা নেই । ফোটন কে বলা হয় বড় দূরত্বে তথ্য সরবরাহে কোয়ান্টাম বিট এর সবচেয়ে ভাল বাহক, কিন্তু ফোটন গুলোর মধ্যে পারস্পরিক কোন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া না থাকার কারণে সম্পূর্ণ আলোর উপর নির্ভরশীল কোন ব্যবস্থা তৈরি করা যায় না,হয়তো এটাই হবে আলোক অণুর সবচেয়ে বড় প্রয়োগ ক্ষেত্র, যদি এরকম একটি আলো নির্ভর ব্যবস্থা আমরা তৈরি করতে পারি সেক্ষেত্রে সিস্টেমের কার্যক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে । এখন আমরা যেই তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করি সেখানে আলোর বিট কে সরাসরি ব্যবহার করা যায় না, আলোর বিট কে প্রথমে ইলেক্ট্রনিক বিটে রুপান্তর করা হয় যা পরে আবার আলোক বিটে রুপান্তর করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আলোকঅণুর ব্যবহারের মাধ্যমে যদি এই ব্যবস্থাটিকে সম্পূর্ণ আলো নির্ভর করা যায় তবে শক্তির অপচয় অনেক কমে যাবে । তবে যেহেতু এটি পদার্থের একটি নতুন অবস্থা এটা সহজেই বলা যায় সময়ের সাথে এই ব্যাপারে অনেক গবেষণা হবে আর তা থেকে আমরা আলোকঅণুর অনেক প্রয়োগক্ষেত্র খুজে পাব। 

তথ্যসূত্র : scientificamerican.com