আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০১৪

হকিং বিকিরণ

কৃষ্ণগহ্বর হতে নিঃসৃত বিকিরণ হকিং বিকিরণ হিসেবে পরিচিত। শুনতে অবাক লাগার কথা, কারণ কৃষ্ণগহ্বরকে আমরা অন্ধকূপ বলেই চিনি। যা সবকিছু নিজের ভিতর টেনে নেয় আর কোনো কিছুই এর থেকে বের হতে পারে না। তাহলে সেখান থেকে বিকিরণ কীভাবে সম্ভব? বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেন যে কৃষ্ণগহ্বরের নির্দিষ্ট এন্ট্রপি আছে। সুতরাং এর নির্দিষ্ট তাপমাত্রাও আছে। যে কোনো বিশেষ তাপমাত্রায় বস্তু নির্দিষ্ট হারে বিকিরণ করে থাকে। তপ্ত লৌহদন্ড যে বিকিরণের ফলে লাল হয়ে যায় তা আমরা চোখেই দেখতে পারি, তবে কম তাপমাত্রায়ও বিকিরণ হয়, সেটা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় পরিমাণে কম বলে। সুতরাং কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা শূন্য না হলে তার থেকে বিকিরণ হওয়া উচিৎ।

কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা এর ভরের উপর নির্ভর করে। ভর যত কম হবে, তাপমাত্রা ও বিকিরণের হার তত বেশি হবে। এক সৌরভরবিশিষ্ট একটি কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা মাত্র ৬০ ন্যানোকেলভিন, অর্থাৎ এরূপ কৃষ্ণগহ্বর যে পরিমাণ নিঃসরণ বা বিকিরণ করে তার চেয়ে অনেক বেশি মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গ শোষণ করে। এক চন্দ্রভরবিশিষ্ট (৪.৫ × ১০২২ কিলোগ্রাম) কৃষ্ণগহ্বর -২৭০.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস (২.৭ কেলভিন) তাপমাত্রায় সাম্যাবস্থায় আসে অর্থাৎ যতখানি শোষণ করে ততটুকু বিকিরণ করে। আর এর চেয়ে ছোট আদি কৃষ্ণগহ্বরগুলি শোষণের চেয়ে বেশি বিকিরণ করে এবং ভর হারায়।

এই বিকিরণ একপ্রকার কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ যা ঘটনা দিগন্তের নিকটে কোয়ান্টাম ইফেক্টের কারণে কৃষ্ণবিবর হতে নিঃসৃত হয় বলে মনে হয়। পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে যিনি গাণিতিক উপায়ে এর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দান করেন। এছাড়া পদার্থবিদ জ্যাকব বেকেনস্টাইন বলেন যে কৃষ্ণবিবরের একটি নির্দিষ্ট অশূন্য তাপমাত্রা ও এন্ট্রপি থাকা উচিৎ। হকিং ১৯৭৩ সনের সেপ্টেম্বরে মস্কো যান, সেখানে সোভিয়েত বিজ্ঞানী ইয়াকভ জেল্ডোভিচ এবং অ্যালেক্স স্ট্র্যাবিনস্কি তাকে বলেন যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি অনুযায়ী ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বর কণা সৃষ্টি করবে এবং বিকিরণও করবে। হকিং তাদের তাত্ত্বিক যুক্তি মানলেও তাদের গাণিতিক প্রক্রিয়াটি পছন্দ করেন নি। নভেম্বরে অক্সফোর্ডে একটি বেসরকারি সেমিনারে তিনি একটি উন্নত গাণিতিক নীতি সহ বিকিরণ পদ্ধতির বিবরণ দেন। এই গাণিতিক গণনায় তিনি লক্ষ্য করেন, কেবল ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরই নয়, বরং অঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরও কণা সৃষ্টি করে স্থির হারে বিকিরণ করতে পারে। হকিং বিকিরণ কৃষ্ণগহ্বরের ভর ও শক্তি হ্রাস করে এবং এটি black hole evaporation নামে পরিচিত। এর কারণে কৃষ্ণগহ্বর যে ভর আত্মসাৎ করে তার চেয়ে বেশি হারায় এবং এতে করে এটি সঙ্কুচিত ও শেষপর্যন্ত বিলীন হবার আশঙ্কা দেখা দেয়! বিজ্ঞানীরা মনে করেন ক্ষুদ্র কৃষ্ণবিবরগুলি বড়গুলোর চেয়ে অধিক হারে নিঃসরণ করে এবং দ্রুত সঙ্কুচিত ও শেষ হয়ে যায়।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে কৃষ্ণগহ্বরের হকিং বিকিরণ সম্পর্কিত একটি সিগন্যাল পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল যার ফলাফল ছিল বিতর্কিত আর ঠিকভাবে যাচাই করা যায় নি। অন্যান্য প্রজেক্টগুলো framework of analog gravity এর মধ্যে এই বিকিরণ খোঁজার চেষ্টা করেছিল। ২০০৮ এর জুনে নাসা bvmv(NASA) GLAST স্যাটেলাইট প্রেরণ করে যা কৃষ্ণগহ্বর নিঃসৃত গামা রশ্মির প্রবাহ অনুসন্ধান করবে। যদি অতিবৃহৎ মাত্রা তত্ত্ব (large extra dimension thiories) সত্য হয় তবে সার্ন (CERN)এর বৃহৎ হ্যাড্রন কলাইডরে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবিবর সৃষ্টি হতে পারে যার বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।

কৃষ্ণগহ্বরগুলো প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় আকর্ষণের প্রত্যক্ষ প্রতিরূপ। সাধারণভাবে এই মহাকর্ষশক্তি এত শক্তিশালী যে কোনো তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গও (যেমন দৃশ্যমান আলো) তা হতে মুক্ত হতে পারে না বা বেরিয়ে আসতে পারে না। কীভাবে মহাকর্ষকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় নিয়ে আসা যায় এটা এখনও অজানা, যদিও কৃষ্ণগহ্বর হতে দূরে গেলে মহাকর্ষের প্রভাব, স্থানকালের বক্রতায় কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্বে মহাকর্ষের ভূমিকার তুলনায় প্রায় উপেক্ষণীয় হয়। হকিং দেখান যে কোয়ান্টাম ইফেক্ট কৃষ্ণগহ্বরকে এর মহাকর্ষ কাটিয়ে বিকিরণে সমর্থ করে যা আদর্শ তাপীয় উৎস (কৃষ্ণবস্তু) হতে নিঃসৃত গড় তাপীয় বিকিরণের অনুরূপ। এই তাড়িতচৌম্বক বিকিরণ কৃষ্ণবস্তু তথা কৃষ্ণবিবরের তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল।

ভৌতভাবে ঘটনাটি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যেন এটি ঘটনা দিগন্ত (কৃষ্ণবিবরের সীমানা, ঐ স্থান হতে কোন আলো না আসায় এর অপরপ্রান্তের কোন ঘটনা জানা যায় না বলে এক ঘটনাদিগন্ত বলা হয়) হতে নিঃসৃত কণা-প্রতিকণা বিকিরণ। বিকিরণটি সরাসরি কৃষ্ণবিবর হতে বের হয় না, বরং এটা ভার্চুয়াল কণাগুলো কৃষ্ণবিবরের মহাকর্ষ দ্বারা প্রকৃত কণায় পরিণত হওয়া বোঝায়।

একটু সরল ভাষায় বলতে গেলে, শূন্যস্থানের ওঠানামা কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্তের কাছে কণাপ্রতিকণার জোড়াকে আবির্ভূত করায়। জোড়ার একটি গহ্বরে পতিত হয়, অন্যটি মুক্তি পায়। শক্তির সংরক্ষণ নীতি অনুযায়ী, গহ্বরে পতিত কণাটি ঋণাত্মক হওয়ার কথা (কৃষ্ণগহ্বর হতে দূরবর্তী পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে)। এই প্রক্রিয়ায় কৃষ্ণবিবর ভর হারায় এবং বহিঃস্থিত পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হয় কৃষ্ণগহ্বরটি একটি কণা নিঃসরণ করল। অন্য একটি মডেল অনুযায়ী, প্রক্রিয়াটি হচ্ছে কণার সুড়ঙ্গযাত্রা বা quantum tunneling effect যেখানে বলা হয় কণাপ্রতিকণা জোড়া শূন্যস্থান হতে উদ্ভূত হয় এবং জোড়ার একটি টানেল দিয়ে ঘটনাদিগন্তের বাইরে বেরিয়ে আসে। 
হকিং এর হিসাবকৃত কৃষ্ণবিবরবিকিরণ এবং কৃষ্ণবস্তুনিঃসৃত তাপীয় বিকিরণের পার্থক্য হচ্ছে দ্বিতীয়টির সংখ্যাবাচক পরিমাণ সম্ভব। তাপীয় বিকিরণ এর উৎসবস্তু সম্পর্কে তথ্যপ্রদান করে, অন্যদিকে হকিং বিকিরণ এমন কোন তথ্যই বহন করে না বলে মনে হয় এবং কেবল কৃষ্ণগহ্বরের ভর, কৌণিক ভরবেগ ও আধানের উপর নির্ভর করে। এটাকে কৃষ্ণগহ্বরের তথ্য সংক্রান্ত প্যারাডক্স ধরা যায়।

gauge gravity duality ধারণানুযায়ী, কতিপয় ক্ষেত্রে কৃষ্ণগহ্বরকে অশূন্য তাপমাত্রায় কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির সমাধানের সমতুল্য ধরা যায়। এর অর্থ, আমরা আশা করতে পারি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত বস্তুর কোন তথ্যই বিনষ্ট হয় না (কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি অনুযায়ী) এবং কৃষ্ণবিবরনিঃসৃত বিকিরণ সম্ভবত সাধারণ তাপীয় বিকিরণ। এই ধারণা ঠিক হলে হকিং এর হিসাবও ঠিক হওয়ার কথা। 
যখন কণাগুলো মুক্তি পায় বা নির্গত হয়,তখন কৃষ্ণগহ্বর এর কিছুটা শক্তি তথা ভর হারায় (আইনস্টাইনের ঊ=সপ২ সমীকরণ অনুযায়ী ভর আর শক্তি একই তা বোঝায়). গ ভরের একটি অঘূর্ণনশীল আধানবিহীন স্কোয়ার্জচাইল্ড কৃষ্ণবিবর হকিং বিকিরণ করে যে ক্ষমতা হারায় তা নিচের সমীকরণ হতে হিসাব করা যায়।

একে স্টেফান-ব্যোলৎজম্যান-স্কোয়ার্জচাইল্ড-হকিং ক্ষমতা সূত্র বলা হয়।
এখানে P = নির্গত শক্তিপ্রবাহ, c = শূন্যস্থানে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গের দ্রুতি, ħ = প্লাঙ্ক ধ্রুবক, G = সার্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবক।
যদি M এর মান এক সৌরভর হয় তবে P এর মান হয় ৯ ×১০-২৯ ওয়াট (খুবই অল্প!)।
যদি আমরা এমন একটা মহাবিশ্ব চিন্তা করি যেখানে একটি কৃষ্ণগহ্বর ব্যতীত অন্য কোন গ্রহ নক্ষত্র গ্রহাণু ধূমকেতু বা জ্যোতিষ্ক কিছুই নেই; অর্থাৎ কোন কিছু উদরপূর্তি করে কৃষ্ণগহ্বরের দেহায়তন বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা থাকছে না, সেই ক্ষেত্রে হকিং বিকিরণের ফলে কৃষ্ণগহ্বরটি লুপ্ত হতে কত সময় লাগবে? বিজ্ঞানীরা সেটাও হিসাব করে দেখেছেন। এক সৌরভরের (১.৯৮৮৯ × ১০৩০ কিলোগ্রাম) কৃষ্ণগহ্বরের জন্য এই আয়ু হবে ২.১ × ১০৬৭ বছর! এই আয়ুষ্কাল বর্তমান মহাবিশ্বের ধারণাকৃত বয়সের (১৩.৭৩ ± ০.১২ × ১০৯ বছর) চেয়ে বহুগুণ বেশি!
কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর অনবরত নানা মহাজাগতিক বস্তু গ্রাস করে নিজের ভর বাড়িয়ে চলেছে। সুতরাং বড়সড় কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যু হবার কোনো আপাত সম্ভাবনাই দেখা যায় না। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘ধূমকেতু’ কবিতায় লিখেছেন “আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি/ আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি!” কবি ভাবার্থে প্রয়োগ করলেও কৃষ্ণগহ্বরের জন্য কথাটি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা যায়। বিশ্ব তো কেবল গ্রহ, কৃষ্ণবিবর নক্ষত্রকেও নিজের ভিতর টেনে নিতে পারে। 
আবার এর অন্যপিঠও আছে। ক্ষুদ্র ভর যেমন ১০১১ কিলোগ্রাম ভরের কৃষ্ণগহ্বরের জন্য এই সময় হবে ২.৬৭ বিলিয়ন বছর মাত্র। আর তাই জ্যোতির্বিদেরা ক্ষয়িষ্ণু এসব কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান করছেন।