আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

সোমবার, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৩

দি ইলিগ্যান্ট ইউনিভার্সঃ সুপারস্ট্রিংস,হিডেন ডাইমেনশনস অ্যান্ড দ্যা কোয়েস্ট ফর দি আলটিমেট থিউরি -২

স্ট্রিং তত্ত্বের প্রাথমিক ধারনাগুলো দেখে নেয়া যাক।
গত পাঠে দেখানো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে উদ্ভূত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে জন্ম নেয়া প্রথম ফ্রেমওয়ার্ক হল স্ট্রিং তত্ত্ব।
গত পাঠে আমরা যেসকল মৌলিক কণিকা দেখেছি, তাদেরকে হয়ত গ্রীকদের দেয়া অ্যাটম উপাধি দেয়া যেতে পারে কারণ আধুনিক পদার্থবিদ্যা অনুসারে এরা বস্তুসমূহের মৌলিক কণিকা, যাদের আর ভাগ করা যায়না। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব অন্য কথা বলে। স্ট্রিং তত্ত্ব বলে এরাও মৌলিক নয়, এরাও অবিভাজ্য নয়। আজকের সবচেয়ে সূক্ষ্মতম প্রযুক্তির চেয়ে আরও অনেক শক্তিশালী প্রযুক্তি দিয়ে পরীক্ষা করা গেলে ঠিকই আরও সূক্ষ্মতর কণিকা আবিষ্কার সম্ভব হবে যাদের দিয়ে ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি গঠিত। তবে এখানে কণিকা বললে আপত্তি আছে কারণ স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে এরা কণিকা নয় বরং এরা একমাত্রিক আঁকাবাঁকা আকারের ফিতা (loop)। এদেরকে পদার্থবিদরা নামকরণ করেছেন স্ট্রিং। স্ট্রিং হল অসীম পাতলা। প্রতিটি কণিকা এরকম কম্পনশীল, দোদুল্যমান ও নৃত্যরত স্ট্রিং দিয়ে গঠিত।
Untitled
বিঃদ্রঃ ছবিটি অভিজিৎ রায়ের ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ থেকে নেয়া।
উপরের একটি আপেলের টুকরো কী কী প্রাথমিক কণিকা দিয়ে গঠিত দেখানো হয়েছে। আধুনিক পদার্থবিদ্যা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনে গিয়ে থামবে কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব আরেকটা সূক্ষ্মতর স্তর যোগ করেছে চিত্রটিতে।
আগে মৌলিকতম কণিকাগুলোকে বিন্দুবৎ ধরা-হয়েছিলো, আর স্ট্রিং তত্ত্বে বলা হল মৌলিকতম অংশ প্যাঁচানো ফিতার ন্যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ছোট্ট পরিবর্তনই কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার মাঝে দ্বন্দ্ব নিরসন করে। স্ট্রিং তত্ত্ব এখানেই সমকালীন কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সাধারণ আপেক্ষিকতার মধ্যেকার কঠিন গিট খুলে দেয়।
আইনস্টাইনের সময় সবল ও দুর্বল বল আবিষ্কার হয়নি, তিনি শুধু দুটি বল দেখেছিলেন মধ্যাকর্ষন ও তড়িৎ-চুম্বকীয় বল। এটিই তার কাছে মনে হয়েছিলো প্রকৃতির একটা অসংযত রূপ, তাই তিনি তার শেষ জীবনের ত্রিশ বছর কাটিয়েছিলেন একটি ‘ইউনিফাইড ফিল্ড থিউরি’ খুঁজে বের করতে। তিনি আশা করেছিলেন তিনি দেখাতে সক্ষম হবেন এই দুইটি বলের ভিত্তি একই।
আইনস্টাইন সবসময় কালের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় পরে তার স্বপ্নের ‘ইউনিফাইড থিউরি’ পদার্থবিজ্ঞানীদের আরাধ্য বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এবং একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদার্থবিদ ও গণিতবিদ বিশ্বাস করেন স্ট্রিং তত্ত্বই পারে এর সমাধান করতে।
স্ট্রিং তত্ত্ব ঘোষণা করে, আমাদের পর্যবেক্ষণ করা সকল বস্তু-কণিকা ও বল কণিকা আর কিছুই না শুধু স্ট্রিং এর বিভিন্নরূপে কম্পনের প্রতিফলন। ঠিক যেমন হারমোনিয়াম কিংবা পিয়ানোর তার গুলো বিভিন্ন রকম কম্পনের ফলে আমরা বিভিন্ন রকম সুর শুনতে পাই সেরকমই স্ট্রিং এর বিভিন্ন রূপ কম্পনের ফলে আমরা বিভিন্ন রকম বস্তু-কণিকা ও বলকণিকা দেখতে পাই। আর এই কণিকাগুলোর ভর ও চার্জ নির্ধারিত হয় স্ট্রিং এর কম্পনের ধরন অনুসারে।
আর পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত, আমরা এমন এক কাঠামো পাই যা সকল প্রাথমিক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পারে যেগুলোর উপর এই মহাবিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে। একারণেই একে Theory Of Everything (সংক্ষেপে T.O.E) অথবা আল্টিমেট অথবা ফাইনাল তত্ত্ব বলা হয়।
এই তত্ত্ব অনেক নতুন বিতর্কেরও জন্ম দেয়। অনেকেই মনে করেন জীবন ও বিশ্বের রহস্যগুলো নিছক নৃত্যরত ফিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত কণিকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন এমন দাবি করা নিরেট বোকামি। আসলেই কী আমাদের আনন্দ, বিস্বাদ সবই আর কিছুই না স্ট্রিং দ্বারা গঠিত অণু-পরমাণুর বিক্রিয়া? এই খোঁচার প্রেক্ষিতে নোবেল বিজয়ী স্টিভেন ভাইনবার্গ বলেন,
At the other end of the spectrum are the opponents of reductionism who are appalled by what they feel to be the bleakness of modern science. To whatever extent they and their world can be reduced to a matter of particles or fields and their interactions, they feel diminished by that knowledge. . . . I would not try to answer these critics with a pep talk about the beauties of modern science. The reductionist worldview is chilling and impersonal. It has to be accepted as it is, not because we like it, but because that is the way the world works.
কেও কেও এই কঠিন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত, কেও কেও দ্বিমত পোষণ করেন।
অনেকেই চাওস তত্ত্ব এনে যুক্তি দেখান তাহলে একটা কোয়ার্ককে বুঝতে পারলে একটা টর্নেডোকে বুঝতে পারা যায়না কেন? কিন্তু এই যুক্তিতে আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়, আসলেই কোয়ার্ক আর টর্নেডোর দু’ক্ষেত্রে দুরকম তত্ত্ব দরকার নাকি কোয়ার্কের ধর্মগুলোই ভীষণ রকম জটিল, যেখানে বুঝার আমাদের ফাঁক-ফোঁকর রয়ে গেছে?
চাওস আর রিডাকশিনিজম দূরে রেখেও সবাই একটা জায়গায় একমত, তা Theory Of Everything (T.O.E) এর গুরুত্ব অসীম। T.O.E ই হতে পারে ‘এই মহাবিশ্ব বোধযোগ্য’ কথার পেছনে সবচেয়ে শক্ত যুক্তি।
তাহলে স্ট্রিং থিউরির অবস্থা নিয়ে কিছু বলা যাক, প্রথমেই বলতে হবে স্ট্রিং থিউরি সবে মাত্র ডিম ফুটে বেরিয়েছে। এটির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণও তেমন হাজির করা যায়নি। মজার ব্যাপার হল স্ট্রিং থিউরি, স্ট্রিং থিউরি নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীরাই এখনো ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি। যদিও গর দুই দশকে বেশ উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তারপরেও স্ট্রিং থিউরি এখনো সকল বৈজ্ঞানিক দ্বারা সমর্থিত নয়।
এবং তাই স্ট্রিং তত্ত্বকে প্রক্রিয়াধীন (in progress) কাজ হিসেবে ধরতে হবে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব ইতিমধ্যে স্থান,কাল ও বস্তুর ধর্ম নিয়ে বেশ কিছু তাক লাগানো খবর জানিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে এক সূতায় গেঁথে ফেলা একটা বড় সাফল্য। তাছাড়া পূর্বের যেকোনো তত্ত্বে চাইতে স্ট্রিং তত্ত্ব একটা দিকে এগিয়ে আছে, একমাত্র স্ট্রিং থিউরিই প্রকৃতির মৌলিকতম উপাদান ও বলগুলোর রহস্য সম্পর্কে বলার ক্ষমতা রাখে। যদি স্ট্রিং তত্ত্ব ঠিক হয়, আমাদের মহাবিশ্বে গঠনকারী প্রাথমিক কণিকাগুলোর ধর্ম চমৎকারভাবে স্থান-কালের সাথে জড়ানো।
স্ট্রিং তত্ত্বের জটিলতা নিয়ে কিছু বলা যাক। বলা হয়, মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্যভেদ করার সময় হওয়ার আগেই হয়ত আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি, যদিও স্ট্রিং তত্ত্বের পরীক্ষণ-নির্ভর ফলাফল হয়তো আমরা আগামী দশ বছরের মধ্যে পেতে পারি। তবে একটা সুখবর হচ্ছে খুব সম্প্রতি স্ট্রিং তত্ত্বই কৃষ্ণ-গহ্বর এর একটা বড় ধরণের ঝামেলা, Bekenstein-Hawking এনট্রপি এর সমাধান করেছে, যা গত প্রায় ২৫ বছর ধরে যেকোনো তত্ত্ব বা প্রস্তাবকে রীতিমত মধ্যমা আঙ্গুল (middle finger) দেখিয়ে এসেছে!
এডওয়ার্ড উইটেন একবার বলেছিলেন
string theory is a part of twenty-first-century physics that fell by chance into the twentieth century
অন্য আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক, ধরুন বাংলাদেশের কোন এক হাতুড়ে টেকিকে, নাসায় ব্যবহৃত হয় এমন এক সুপার কম্পিউটার দিয়ে দেয়া হল কোন ম্যানুয়াল ছাড়া। এই টেকির অবস্থা হবে কেমন? খানিক গুঁতোগুঁতি করতেই বুঝবে এর ক্ষমতা অনেক, কিন্তু ঠিক এই বিশাল ক্ষমতার কারণেই তার একে সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে সময় লাগবে। স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের অবস্থাও সেরকম, স্ট্রিং তত্ত্বের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার খানিক ঝলকানি দেখে তারা মরিয়া একে সম্পূর্ণ সম্পূর্ণরূপে বুঝতে তবে ঐযে সুপারকম্পুর মত একেও সম্পূর্ণ বুঝে উঠা একদিনের কাজ নয়।
হয়ত কয়েক যুগ এমনকি শতক লেগে যেতে পারে স্ট্রিং তত্ত্বকে বাগে আনতে। এর গণিত খুব বেশী জটিল, এত জটিল যে এখনো স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা জানেন না একদম সঠিক সমীকরণ কী হবে। তাই বিজ্ঞানীরা সঠিকের কাছাকাছি সমীকরণ দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন। তবে এই সমীকরণগুলোও এত জটিল যে এগুলোর মাত্র আংশিক সমাধান হয়েছে । তবে আশার কথা হল নব্বইয়ের দশকের পর এটা ভালোই সাড়া জাগিয়েছে এবং সারা বিশ্বের অনেক পদার্থবিদ ও গণিতবিদ এগিয়ে এসেছেন এই ক্ষেত্রে নতুন নতুন কৌশল ও সমাধান দিতে।
অবাক করার মত বিষয় হল এই স্ট্রিং বিপ্লব, স্ট্রিং তত্ত্বের একেবারে গোঁড়ার দিকের ব্যাপার স্যাপারেও অবদান রাখছে। উদাহরণ হিসেবে, কেন স্ট্রিং? কেন স্ট্রিং এর চাইতেও আরও ক্ষুদ্রতর, মৌলিকতর কিছু নয়?
এসব নিয়ে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে আরও উচ্চতর ধারণা, এম তত্ত্ব!
বিজ্ঞানের চলার পথ একরকম নয়। কিছু সময় বিজ্ঞানীরা বৈপ্লবিক আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে যান, কিছু সময় তারা শুষ্ক দিন কাটান। বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক ও পরীক্ষণ-নির্ভর গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে চলেন। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে শেষ আমাদের জানা নেই। স্ট্রিং তত্ত্ব সেই ধারাবাহিকতারই একটা আধুনিক প্রচেষ্টা, মহাবিশ্বের চরমতম সত্যগুলোকে জানার পথের রথ।
স্ট্রিং তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তবে যে স্থান-কাল চাদরের ধারণা আইনস্টাইন দিয়ে গেছেন, তিনিও এই চাদরের বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে অবাক হতেন।

পদার্থবিদ ‘ব্রায়ান গ্রীন’ এর লেখা “দি ইলিগ্যান্ট ইউনিভার্সঃ সুপারস্ট্রিংস,হিডেন ডাইমেনশনস অ্যান্ড দ্যা কোয়েস্ট ফর দ্যা আলটিমেট থিউরি” বইয়ের উপর ভিত্তি করে লেখা।