আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

বৃহস্পতিবার, মার্চ ০৬, ২০১৪

মহাবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে--- বহুদূরে

সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষের জানার আগ্রহ।আর সেই আগ্রহ থেকেই হাজার প্রশ্নের উৎপত্তি। সেই সকল প্রশ্নেরই উত্তর দিব আজ_____ 
কয়েক শতাব্দী আগেও আমাদের মহাবিশ্ব ছিল আকাশে দেখা অগণিত তারার মধ্যে সীমাবদ্ধ, আকাশের এই তারাগুলোর আবর্তন দেখে তখন পৃথিবীকেই বসিয়ে দেয়া হয়েছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে। তখন আমরা জানতাম সূর্যই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে। এরপর সময় কাটল অনেক। অ্যারিস্টকার্কাস আসলেন, আসলেন অনেক মুসলিম বিজ্ঞানি, আমাদের উপমহাদেশের অসংখ্য জ্ঞানতাপস,ইউরোপে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিওর মত অনেকেই। দেখা গেল সূর্য না পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরে, যার পরিণতি হিসেবে পৃথিবী থাকলনা আর মহাবিশ্বের কেন্দ্র।আরও সময় গেল। গত শতাব্দীতেই আমরা দেখলাম বিজ্ঞানের দূর্বার এগিয়ে চলা। প্রথমে আমাদের জগত ছিল সূর্য কেন্দ্রিক, এরপর আমরা পেলাম আমাদের সৌরজগত, তখন এটাই ছিল আমাদের জন্যে অনেক বড়। কিছুদিন পর দেখা গেলো সূর্যের মত, না সূর্যের চেয়েও অনেক অনেক বড় নক্ষত্র ও আছে আমাদের আশেপাশে, বাড়ল আমাদের মহাবিশ্বের পরিধি। তারপর? না, এখানেই তো শেষ না! আমরা তো একটা গ্যালাক্সির মাঝে বাস করি যার নাম মিল্কিওয়ে, যার ব্যাস প্রায় একলক্ষ আলোকবর্ষ আর যেখানে আছে প্রায় ২০ হাজার কোটি নক্ষত্র, নিঃসন্দেহে অনেক বড়। না তাও হল না, দেখা গেল মিল্কিওয়ে একমাত্র গালাক্সি না,গ্যালাক্সির সংখ্যা এত বেশি তা আসলে গুনে শেষ করা সম্ভব না। তাহলে? আমাদের মহাবিশ্ব তো আসলে অনেক বড়! পরে হিসেব করে দেখা গেল আমাদের মহাবিশ্বের বয়স এখন প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। এই বিশালত্ব আসলেই অপূর্ব কিন্তু কথা হল এখানেই কি শেষ সৃষ্টির এই বিস্তৃতি? মহাবিশ্বের সীমানার ওপারে কি আর কিছুই নেই? আর আমাদের সৃষ্টির আগেই বা কি ছিল? অতি আদিম এইসব প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বের করার চেষ্টা করব আজ, আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে । 
মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হল?- এ প্রশ্নের একটি সাধারণ উত্তর আমাদের সবারই জানা – বিগ ব্যাং নামের এক অভাবনীয় বিস্ফোরণ এর মাধ্যমে। এখান থেকেই শুরু করি, যেই অতি ক্ষুদ্র কণা থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি তাকে বলা হয় ইনফ্লাটন ( Inflaton )। ইনফ্লাটনের প্রাথমিক অবস্থা ছিল অনেক সুবিন্যস্ত আর এই কণা ধারণ করছিলো বিশাল পরিমাণ শক্তি। এখানে সবচেয়ে অবাক করে দেয়ার মত যে বিষয়টি তা হল এরুপ একটি কণিকা থেকে এরকম একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার সম্ভাব্যতা অনেক অনেক কম, প্রায় ১:১০^১০^১২৩ ! তাহলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে কেন আমাদের মহাবিশ্ব এতো সুন্দর ভাবে সাজানো আর যেই ইনফ্লাটন থেকে আমাদের সৃষ্টি সেটাই বা কিভাবে আসলো, কোত্থেকেই বা আসলো। মহাবিশ্বেরStandard Model (যেখানে বিগ ব্যাং এর কথা বলা হয়েছে) – এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না আর এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। 
যাই হোক ইনফ্লাটনের ব্যাপারে আসি। যদি ইনফ্লাটনকে একটি কোয়ান্টাম কণিকা ধরে নেয়া হয় তাহলে বলা যায় অন্য সব কোয়ান্টাম কণার মত ইনফ্লাটনের ও নিজস্ব কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ( সহজ ভাবে বলতে গেলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বলতে কোন নির্দিষ্ট বিন্দুতে খুব অল্প সময়ের জন্যে শক্তির পরিবর্তন কে বোঝায়। ) আছে যার প্রভাবে মহাবিশ্বের প্রথম সময়গুলোতে স্পেসটাইমের বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। আর প্রাথমিক পর্যায়ে ইনফ্লাটনের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর মত অতিক্ষুদ্র ঘটনার নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয় আমাদের আজকের দেখা বস্তুজগত। ভাবতে অবাক লাগে ওই পর্যায়ে যদি এই ধারাবাহিকতায় সামান্য পরিবর্তন ও হতো তাহলে হয়ত পৃথিবীর কোনদিন জন্মই হতো না।
এবার CMB সম্পর্কে কিছু বলব। বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের পর একটা বিশাল পরিমাণের বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে। মহাবিশ্বের ক্রম সম্প্রসারণের সাথে সাথে এই বিকিরণের তীব্রতাও ক্রমশঃ কমতে থাকে এবং এটা এখনও কমছে। একভাবে বলতে গেলে এই বিকিরণকে বলা যায় আমাদের আদিম মহাবিশ্বের ছবি। এই বিকিরণকেই বলা হয় CMB বা Cosmic Microwave Background। ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞানী আরনো পেঞ্জিয়াস এবং রবার্ট উইলসন সর্বপ্রথম CMB-র অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। CMB আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রথম কিছু মুহূর্তের তথ্য ধারণ করে বলে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে তার গুরুত্ব অসীম। ইনফ্লাটনের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কথা বলছিলাম উপরে। এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে CMB ফোটনেরও ( প্রতিটি বিকিরণ মাত্রই ফোটন) তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে, এই ঘটনাকে বলা হয় CMB Anisotropies Spectrum ( এখানে Anisotropy বলতে বোঝানো হচ্ছে যে এই তাপমাত্রার পরিবর্তন দিকনির্ভরশীল ছিল, অর্থাৎ বিভিন্ন দিকে এই তাপমাত্রার পরিবর্তন সমান ছিল না।) এখন মজার ব্যাপার হল Standard Model অনুযায়ী এই ধরণের পরিবর্তন হওয়ার কথা না। এটাকে আর একটু সহজ ভাবে বলি, ইনফ্লাটনের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন তখনই সম্ভব যখন ইনফ্লাটনকে আমরা কোয়ান্টাম কণিকা হিসেবে ধরব, Standard Model মহাবিশ্বের এই প্রাথমিক অবস্থাকে কোয়ান্টাম কণা হিসেবে বিবেচনা করে না। এখন দেখার ব্যাপারটি হচ্ছে Standard Model মহাবিশ্বে তাপমাত্রা আর বস্তুকণার পরিমাণের মধ্যে একটা প্রতিসাম্যের কথা বলে কিন্তু সেই প্রতিসাম্য মহাবিশ্বে অনুপস্থিত। এর একটা পার্শ্বিক কারণ হিসেবে CMB Anisotropies Spectrum কে দায়ী করা হয়, যদিও এটা একটা গাণিতিক অনুমান, সত্যি ধরে নেয়া হলে বলা যায় হয়ত ইনফ্লাটন কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসরণ করেছে।
আজ থেকে আরও প্রায় ৫০ বছর আগে হিউ এভেরেট নামের একজন ভদ্রলোক তার পি.এইচডির থিসিস এর গবেষণায় সর্বপ্রথম মহাবিশ্বের শৈশবের সময়টাকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আওতায় এনে কিছু হিসেব নিকেশ করেন। তিনি ভাবতেন যে শিশু অবস্থায় আমাদের মহাবিশ্ব যেহেতু অনেক ক্ষুদ্র ছিল তাহলে এই ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োগ করতে কোন বাধা নেই। এই ভাবনা থেকে তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা তত্ত্ব ব্যবহার করে তিনি প্রাথমিক মহাবিশ্বকে একটি ওয়েভ প্যাকেট ( কোন তরঙ্গগুচ্ছ যা এককভাবে ভ্রমণ করে) এর সাথে তুলনা করেন। কিন্তু এই তুলনা থেকে একটা অদ্ভুত ফলাফল পাওয়া যায় । তিনি এই অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওয়েভ প্যাকেটের অনেকগুলো গাণিতিক সমাধান আবিষ্কার করে ফেলেন, যেই আবিষ্কারের অর্থ ছিল একটাই আর তা হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে আমাদের মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব এ কথাটা হয়ত ঠিক না ! কিন্তু এই অন্য মহাবিশ্বগুলো মানুষের পর্যবেক্ষণের সীমার বাইরে ছিল বলে তার এই আবিষ্কার নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা এভেরেটের জন্যে সত্যি কঠিন ছিল, তবু তিনি এই ধারণা নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেন। তিনি তার গবেষণায় দেখান যে পদার্থবিজ্ঞানের এমন কোন বৈশিষ্ট্য বা শর্ত নেই যা এই বহুবিশ্ব তত্ত্বকে পুরোপুরি নাকচ করে দেয়। ফলাফলসরূপ তিনি এই সিদ্ধান্তেও পৌঁছান যে একাধিক মহাবিশ্বের উপস্থিতি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রাকৃতিক ফলাফল। তার এই যুক্তিগুলো এতোটাই আকর্ষণীয় ছিল যে তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক নিলস বোরের দৃষ্টিও আকর্ষণ করে। কিন্তু পরবর্তীতে এই তত্ত্বকে সমর্থন করার মত অন্য কোন তত্ত্বের অনুপস্থিতি আর এই ব্যাপারে এভেরেট নিজে গবেষণা থেকে সরে আসায় বহুবিশ্ব তত্ত্ব ধীরে ধীরে সবার আড়ালে চলে যায়। 

এভেরেটের এই তত্ত্ব প্রকাশের পর প্রায় ৪০ বছর এই ব্যাপারে উল্লেখ করার মত কোন গবেষণা হয়নি। এক দশক আগে স্ট্রিং তত্ত্বের মাধ্যমে বহুবিশ্ব তত্ত্বের পুনর্জাগরণ ঘটে। এই তত্ত্ব কে এখন বলা হচ্ছে Theory of Nature হবার জন্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী প্রার্থী। এখন আসা যাক কিভাবে স্ট্রিং তত্ত্ব বহুবিশ্বের অস্তিত্বকে সমর্থন করছে। স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বে মাত্রা ( Dimension ) আছে ১১ টি, আর এটাই তত্ত্বটির অস্তিত্বের প্রতি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এটার কারণ আমাদের জানা- জগতে আমরা মাত্র ৪ টি মাত্রার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি- দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময়। তাহলে যে তত্ত্বের মাত্রা আমাদের দেখা জগতের সাথেই খাপ খায়না তা কিভাবে Theory of Nature তথা Theory of Everything হতে পারে? স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে এই অতিরিক্ত ৭ টি মাত্রা প্রথমত অনেক ক্ষুদ্র স্কেলে কাজ করে আর এরা এমনভাবে বক্রতা সৃষ্টি(Curling) করে যার কারণে তাদের অস্তিত্ব আমাদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়( কঠিন করে ফেললাম? সবাই হয়ত ৩ মাত্রার একটি পাইপ দেখেছেন। অনেক দূর থেকে দেখলে একে কি ৩ মাত্রার মনে হয় ? তখন একে মনে হয় এক মাত্রার একটা তারের মত, মাত্রা অদৃশ্য করার ব্যাপারটি অনেকটা এরকমই) 
এখন কথা হল স্ট্রিং তত্ত্ব অনুযায়ী এই বাঁকিয়ে ফেলা আর সেই অতিরিক্ত ৭ মাত্রার শক্তিকে অবশিষ্ট চার মাত্রায় আনার কাজটি অনেক ভাবেই করা সম্ভব। এই শতাব্দীর শুরু থেকেই গণিতবিদরা এই সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, আর এ গবেষণা শেষে দেখা গেল নিঃসন্দেহে আমাদের চার মাত্রার এই জগতের সূচনা হওয়ার অনেক সম্ভাব্য উপায় রয়েছে । এই সম্ভাব্য পদ্ধতিগুলোর নিজস্ব শক্তির রূপরেখা স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষকদেরই রীতিমত চমকে দেয়। তারা দেখেন এই পদ্ধতির প্রত্যেকটিতেই বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্ভব। এভাবে স্ট্রিং তত্ত্বেও বহুবিশ্ব ধারণাটির জন্ম হয়। কিন্তু এভেরেটের মতই এখানেও বহুবিশ্ব নিয়ে প্রশ্ন ছিল কিন্তু ছিল না কোন পর্যবেক্ষণলব্ধ প্রমাণ। কারণ আগেই বলছিলাম , এ সবই মডেলের গাণিতিক প্রকাশে প্রমাণিত সত্য, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বহুবিশ্ব তত্ত্বটিকে কোন পরীক্ষার দাঁড়িপাল্লায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না ততক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কাছাকাছি কোন নিশ্চয়তাও দেয়া যাচ্ছিল না। আর এখানে আরও একটি প্রশ্ন ছিল-যদি ইনফ্লাটন থেকে অনেক মহাবিশ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকেই থাকে তাহলে কোন বিশেষ কারণে আমাদের মহাবিশ্ব এই সম্ভাব্যতায় টিকে গেলো? 

এমতাবস্থায় ২০০৫ সালের দিকে একদল বিজ্ঞানী এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন তাত্ত্বিক ভাষায়। তাদের মতে যদি আমাদের মহাবিশ্ব কেন টিকে গেলো তার উত্তর বের করতে হয় প্রথমে আমাদের মেনে নিতে হবে যে প্রাথমিক ভাবে আমাদের মহাবিশ্বের মত আরও শিশু মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল, তারপরই আমরা বের করতে পারব কেন আমাদের মহাবিশ্ব আমাদের জন্যে নির্বাচিত হল আর বাকি মহাবিশ্ব গুলোরই বা কি হল। এরপর তারা এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ঘটনাটির একটি ল্যান্ডস্কেপ (একটি গঠন যা শিশু মহাবিশ্বগুলোকে ধারণ করে) কল্পনা করেন যেখানে শিশু অবস্থায় আমাদের সাথে সাথে আরও অনেক মহাবিশ্ব বিদ্যমান,এই ল্যান্ডস্কেপে শিশু মহাবিশ্ব গুলোকে তারা বিবেচনা করলেন এক একটি ওয়েভ প্যাকেট এর মত কণা হিসেবে। এখন প্রশ্ন হল মহাবিশ্বগুলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে ( এই প্রকল্পে সব কিছুই কোয়ান্টাম সীমার মধ্যে হচ্ছে বলে ধরে নেয়া হয়েছে) কিভাবে বিবর্তিত হবে? আপাতত মহাবিশ্বগুলো এই অবস্থাতেই থাক, এর মাঝে আমরা আমাদের চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দেখে আসি।
ঘটনাটি হল কোন মাধ্যমে ইলেকট্রনের সঞ্চালন । কোন অন্তরক পদার্থ (যেমনঃ কাচ) কিংবা কোন ত্রুটিপূর্ণ তার- আণবিক দিক থেকে এই গঠনগুলোর বিভিন্ন বিন্দুতে শক্তির মাত্রা, পরিমাণ ও বণ্টনের কোন নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই, এই বণ্টন পুরোপুরি বিশৃঙ্খল, কোন কোন বিন্দুতে শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি, কোথাও অনেক কম। ধরে নিলাম আমাদের একটি পরীক্ষায় ইলেকট্রন সঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে কাচ নেয়া হল।আমরা জানি এই কাচের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হবে না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যা ঘটে তা হল ইলেকট্রনগুলো কাচের এই বিশৃঙ্খলভাবে বন্টিত শক্তির কারণে বিভিন্ন বিন্দুতে আটকে যায়। ফলে কাচের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন আর সঞ্চালিত হতে পারে না। সেই বিজ্ঞানীদের কল্পনার ল্যান্ডস্কেপে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছুটে চলা শিশু মহাবিশ্বগুলোর সাথে এই ইলেকট্রনগুলোর আর ল্যান্ডস্কেপটিকে তুলনা করা যায় এই কাচ মাধ্যমের সাথে। শিশু মহাবিশ্ব ধারণ করা ল্যান্ডস্কেপটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ধারণ করে আর এই শক্তির বিন্যাস বিভিন্ন বিন্দুতে কাচের আনবিক ক্ষেত্রে শক্তির বিন্যাসের মতই বিশৃঙ্খল। এখন কথা হল এই ল্যান্ডস্কেপটির শক্তির বিন্যাস যদি সুসজ্জিত সুশৃঙ্খল হত, তাহলে কি সমস্যা হত তথা এই বিশৃঙ্খল শক্তি বিন্যাসের ল্যান্ডস্কেপ কেন কল্পনা করা হল। আবার ইলেকট্রনের জায়গায় ফিরে আসি। এখন আমরা একটা পরিবাহী মাধ্যমের কথা চিন্তা করি, আণবিক ক্ষেত্রে পরিবাহীর বিভিন্ন বিন্দুতে শক্তি খুব সুশৃঙ্খল ভাবে বন্টিত। আর এই কারণে ইলেকট্রন তেমন উল্লেখযোগ্য কোন বাধা ছাড়াই পরিবাহীর মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়। একই ভাবে ল্যান্ডস্কেপটি যদি সর্বনিম্ন শক্তিধারী ( কোন বিন্দুতে সর্বনিম্ন শক্তি তার স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে) বিন্দু দ্বারা সুসজ্জিত হত তাহলে এই শিশু মহাবিশ্ব গুলো অনন্তকাল ধরে এই ল্যান্ডস্কেপে বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘুরতে থাকত। তাহলে কোন মহাবিশ্বই কখনো সৃষ্টি হত না। এখন আমরা যেটা জানি তা হল আমাদের মহাবিশ্বের প্রাথমিক শক্তির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি প্রায় ১০^২৫ ইলেকট্রন ভোল্ট। এর মানে এটাই যে ল্যান্ডস্কেপের যে বিন্দু থেকে আমাদের মহাবিশ্বের যাত্রা, সেটি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ছিল। কিন্তু এখানে আর একটা প্রশ্ন থেকে যায়, কেন আমাদের মহাবিশ্ব কম শক্তির স্থিতিশীল কোন বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করল না? এর সম্ভাব্য উত্তর একটিই হতে পারে আর তা হল সেক্ষেত্রে হয়তো বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে এই শিশু মহাবিশ্ব আমাদের আজকের বিশাল মহাবিশ্বে পরিণত হতে পারত না। 
উপরের ঘটনাগুলো একটা গল্পের মত লাগতে পারে, কিন্তু এটা কোন হাইপোথিসিস না, এর সম্পূর্ণটাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিভিন্ন সমীকরণ ব্যবহার করে পাওয়া। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা এখানে যে এই ব্যাখা গত শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত দুটি বিষয়- কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর স্ট্রিং তত্ত্বকে একটি বহুবিশ্ব তত্ত্বে একীভূত করে দেয়। কিন্তু সবকিছু হয়েও যেন কিছুই হয়না, এখন পর্যন্ত যা বললাম সবই ছিল তত্ত্ব আর গণিত। কিন্তু কিভাবে একে পরীক্ষা করা যায়? কিভাবে আমরা খুঁজে পাব আমাদের প্রতিবেশী এসব মহাবিশ্বকে? 
এই প্রশ্ন গবেষকদেরও ভাবিয়েছে অনেকদিন ধরেই। সবশেষে তারা এটারও একটা সমাধান বের করলেন। বিগব্যাং এর শুরুর দিকে শিশু মহাবিশ্ব গুলো একসাথে ছিল, সময়ের সাথে আমাদের মহাবিশ্বের পরিধি বাড়তে থাকলে একটা সময় এসে ডিকোহেরেন্স ( Decoherence) নামের একটা প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বগুলো পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যায় চিরদিনের জন্যে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে Unitarity Principle বলতে একটা নীতি আছে যেটা বলে কোন সিস্টেমের তথ্য কখনো হারিয়ে যায় না। আর এই নীতি অনুসারে মহাবিশ্বগুলোর পরস্পর যুক্ত থাকার কোন না কোন নিদর্শন আমাদের মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও থাকা উচিত। LAURA MERSINI–HOUGHTON, Tomo Takahashi, Richard Holman- নামের তিনজন বিজ্ঞানী ২০০৬ সালে Avatar’s of the Landscape –এই শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এখানে মহাবিশ্বের এই যুক্ত থাকার নিদর্শন গুলো কি রকম হতে পারে সে ব্যাপারে গাণিতিক হিসেবের মাধ্যমে কিছু ধারণা প্রকাশ করা হয়। এই ধারণাগুলোর মধ্যে ছিল মহাবিশ্বগুলো একসাথে থাকার কারণে CMB-র যে ক্ষমতা থাকার কথা তা না থাকা, আমাদের মহাবিশ্বে পদার্থের বণ্টনের মধ্যে কিছুটা অসামঞ্জস্য তথা Cold spot বা Giant Void এর উপস্থিতি,CMB-র বর্ণালি সূচকের( Spectral Index) মান দূরত্বের সাথে পরিবর্তন ( Standard Model অনুসারে যার মান ধ্রুবক হবার কথা ) ইত্যাদি ( Avatar’s of the Landscape এ এরকম নয়টি নিদর্শনের কথা বলা হয়েছিল)।

আপনারা নিশ্চয় Planck এর নাম শুনেছেন, না বিজ্ঞানী প্লাঙ্ক এর কথা বলছিনা , এটি একটি কৃত্রিম উপগ্রহ যা ২০০৯ সালে CMB –র ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণার জন্যে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। ২০১৩ সালের মার্চে তার মিশনের চার বছরের মাথায় Planck CMB-র এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বিস্তারিত মানচিত্র প্রকাশ করে। এই মানচিত্রের তথ্যে Avatar’s of the Landscape-এর তিন গবেষক অনেক উচ্ছ্বসিত। ধারণা করে দেখুন কেন ? না অপেক্ষায় রাখব না, Avatar’s of the Landscape –এর বেশিরভাগ নিদর্শনের অনুমান ছিল CMB ভিত্তিক, আর Planck এখন পর্যন্ত যে তথ্যগুলো প্রকাশ করেছে তা এই নয়টি অনুমানের মধ্যে ৭ টির সাথে মিলে যায়। এটা এই গবেষকদের জন্যে সত্যি একটা বড় অর্জন, এছাড়া আর ও যে অনুমানগুলো করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছাড়া (Dark flow prediction: এই অনুমান অনুসারে অন্য মহাবিশ্বের সাথে যুক্ত থাকার কারণে আমাদের মহাবিশ্বের মহাকর্ষীয় বিভবের একদিকে কাত হয়ে যাওয়ার কথা, যার কারণে মহাবিশ্বের কাঠামোগুলো একটি নির্দিষ্ট দিকে সমান বেগ বজায় রেখে প্রবাহিত হবে বলে ধারণা করা হয়, এই প্রবাহকে Dark flow বলা হয়, কিন্তু এই অনুমানটি এখনও নিশ্চিত করা যায় নি।) বাকি অন্যটির সত্যতা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে LHC-তে এবং সব ফলাফলই নির্দেশ করছে হয়তো আমাদের মহাবিশ্ব একা নয়। যদিও এখনও আরও অনেক হিসেব নিকেশ বাকি,অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি, অনেক তত্ত্বই এরকম প্রাথমিক পরীক্ষায় টিকে গেলেও পরে প্রশ্নের মুখে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আর এখনও একটি অনুমান যেহেতু প্রমাণ করার মত পরীক্ষা করা যায়নি,আমাদের প্রতিবেশীদের ( যদি সত্যি তারা থেকে থাকে) সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও বেশ কিছু দিন। 
ধরে নিলাম একদিন এটা সত্যি নিশ্চিত হওয়া গেলো, তারপর? সেদিন থেকে আমরা জানব সৃষ্টির বিস্তৃতি আমাদের মহাবিশ্বেই শেষ নয়। একই সাথে এটাই হবে স্ট্রিং তত্ত্বের প্রথম পরীক্ষিত প্রমাণ। আর এরপর থেকে শুরু হবে আরও অনেক প্রশ্ন আর সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এক অবিরাম যাত্রা। একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই আবিষ্কারের পর থেকে মানবসভ্যতার অনেক কিছুই বদলে যাবে। সেই বদলে যাওয়া দিনের অপেক্ষায় ... 

2 মন্তব্য:

ফাইযুল হক বলেছেন...

অসাধারন হইছে... চালিয়ে যান।

Unknown বলেছেন...

সুন্দর