১।
১৯২১ সাল, পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি বিশেষ বছর; কারন এবারেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যাক্তির নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। আবার বঙ্গভঙ্গ এবং তা রদের পরে সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগানো বাংলার রাজধানী ঢাকায় ঠিক এ বছরই শুরু হয় একটি ইতিহাসের যাত্রা, যার নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই শুরুর সময়কার বিভাগগুলোর একটি হল পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ। কিন্তু আইনস্টাইন-ম্যাক্সপ্ল্যাঙ্ক-বোর প্রমুখের মত ডাকসাইটে পদার্থবিজ্ঞানীদের স্বর্নযুগে অজ-পাঁড়াগায়ের সে নবীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বৈপ্লবিক কোন চিন্তা বা অনুমিতির (hypothesis) জন্ম হতে পারে সেটা বোধহয় কেউই ভাবেনি। আর এ অভাবনীয় কাজটিই ১৯২৪ সালে করে বসেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।</p>
কার্জন হল থেকে খোদ আইনস্টাইনকে চিঠি (ছবি দ্রষ্টব্য) লিখে জানান যে ম্যাক্সপ্ল্যাঙ্কের এক হিসাবে একটু গড়মিল আছে, হিসাবটা অন্যরকম হলে ভাল হত। বিকল্প হিসাবের নমুনাও দেখান তিনি। আইনস্টাইন সমঝদার মানুষ। তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব (ছবি দ্রষ্টব্য) দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বসুর ইংরেজি প্রবন্ধটি নিজেই জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে “সাইটশ্রিফট ফুর ফিজিক” নামের জার্নালে প্রকাশের অনুরোধ জানান সম্পাদককে। সে অনুরোধ যে গৃহীত হয় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কি ছিল সেই চিঠিতে? কি এমন চিন্তা যাতে আইনস্টাইন তৎক্ষণাৎ সাড়া দিলেন? আসুন জেনে নেই।
২।
মুশকিল হল, সত্যেন বসু ঠিক কি করেছিলেন সে ব্যাপারে আমাদের অনেকেরই কোনও ধারনা নেই। এই সুযোগে বদলে দেবার পত্রিকাটি নির্দ্বিধায় লিখে ফেলে “সত্যেন বসু আইন্সটাইনের সাথে নতুন পরিসংখ্যান আবিষ্কার করেন, এটাই বোসন কণা” যেন ছিল রুমাল- হয়ে গেল বেড়াল। কিংবা মুসাফিরের হাতে গড়া সুপ্রাচীন পত্রিকাটিতে ফরহাদ মজহার লিখে বসেন “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন বোস আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব শুধরে দিয়েছিলেন”। অজ্ঞানতা বশত আমরা গদ গদ হয়ে সে আবর্জনা গিলি, কখনো বয়েও বেড়াই। আমরা অনেকেই সার্সন রোডের পিয়ানো বাজানো মানুষটিকে চিনতে পারি তাঁর প্রয়ানের পরে। অথচ সকাল-বিকাল নিয়ম করে ভারতীয় শান্তিটিভিতে জোকার্নায়কের রিয়ালিটি শো দেখে গলে যাই, ইউটিউবে তেতুলের গুণগান শুনে লজ্জা পাই। আমরা কাদের মোল্লার উঁচানো আঙ্গুল আর অশ্লীল হাসি দেখে ক্ষেপেক্ষুপে শাহবাগে ঘুরান দিয়ে এসে মাস ফুরাতেই সব ভুলে যাই। কিংবা গোলামের নুরানী চেহারা দেখে “আহা, বেচারা বুড়ো মানুষ” ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আর অল্প একটু তথ্যের অভাবে সত্যেন বসু পড়ে থাকেন ঝাঁপির ভেতর, ঝাঁপি থাকে রথের ভিতর, আর সেই রথ থাকে বুয়ান দ্বীপের তলায় । যাকগে, ধান ভানতে বসে শিবের গীত গাইতে গাইতে একেবারে স্বর্গের রংমহলে পৌঁছে যাচ্ছি, এবার লাইনে আসি। অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বেই কিন্তু কিছু অনুমিতি থাকে, কখনও তা সহজ-স্বাভাবিক, কখনও বা বৈপ্লবিক। যেমন ম্যাক্সপ্লাঙ্ক যখন ‘শক্তি নিরবিচ্ছিন্ন নয়, বরং টুকরো টুকরো’ এই ধরে হিসেব কষলেন এটি ছিল রীতিমত বিপ্লব। কিংবা বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে আইনস্টাইন আলোর গতিবেগ ঠিক রাখতে গিয়ে স্থান-কাল সব নড়িয়ে দিলেন। ‘আলোর গতিবেগ সর্বত্র সমান’ এটিও আইনস্টাইনের এক বৈপ্লবিক অনুমিতি। তেমনি সত্যেন বসুও কিছু বৈপ্লবিক অনুমিতির জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন কোয়ান্টাম কণার দশা-স্থানের (phase-space) ক্ষুদ্রতম আয়তন হল h কিউব [h হল গিয়ে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক, এটিই যেকোন শক্তির নুন্যতম অংশ] যা অনেক পরে হাইজেনবার্গের তত্ত্ব দ্বারা প্রমাণিত হয়। আর সবচেয়ে আকর্ষনীয় চিন্তাটি হল- তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে আলোক কণা গুলো সব হুবহু একই রকম, যমজ বাচ্চাদের মত। এর পরের হিসাবটুকু একেবারেই সোজা।
৩।
পৃথিবীর যেকোনো একটি Homo Sapience নেয়া হলে, মোটা দাগে সে হয় মানুষ হবে, নয়তো অমানুষ হবে। এরপরে হিন্দুমুস্লিমবৌদ্ধখ্রিস্টানআর্যনার্যব্রাহ্মনশুদ্রশিয়াসুন্নিকাদিয়ানিমুতাজিলা ইত্যাদি ম্যালা গিয়ানজাম। তেমনই মহাবিশ্বের যেকোনো একটি মৌলিক কণা নেয়া হলে মোটা দাগে সেটা হয় ‘বোসন’ নয় ‘ফার্মিওন’ হবেই হবে। এরপর ইলেক্ট্রন-প্রোটন-নিউট্রন-ফোটন-গ্লুয়ন-ব্যারিওন-লেপ্টন-মেসন ইত্যাদি হরেক জাত-পাতের ম্যালা গিয়ানজাম আছে, সেদিকে আপাতত না যাই। যাহোক, এই বোসন নামটাই এসেছে বসুর নাম থেকে, আর ফার্মিওন এসেছে আরেকজন বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নাম থেকে। মৌলিক কণাদের মাঝে যারা হুবহু একই রকম তারা হল বোসন। এরা একই সাথে একই জায়গায় গাদাগাদি করে অনেকগুলো একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারে। এরা অনেকে মিলে একপাতে খায়, একখাটে ঘুমায়, একলাইনে প্রাতঃকৃত্য করতেও দ্বিধা করে না। শ্রদ্ধেয় এ এম হারুন অর রশীদ স্যারের ভাষায়- “বোসন হল আড্ডাবাজ বাঙ্গালীর মত”। পদার্থবিজ্ঞানের খটোমটো ভাষায় যাদের স্পিন আস্ত, মানে ১,২,৩ ইত্যাদি তারাই হল গিয়ে বোসন। [যারা ভাবছেন স্পিন আবার কি তাদের জন্য বলি স্পিন, মৌলিক কণিকাদের একটি ধর্ম। স্পিনের বিস্তারিত গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক] অন্যদিকে বাকী অর্ধেক কণা, অর্থাৎ ফার্মিওনরা প্রচণ্ড হিংসুটে আর ঝগড়াটে। ফার্মিওন সমাজে বর্ণভেদ প্রচণ্ড। হুবহু একই অবস্থার দুটো ফার্মিওন কখনওই পাওয়া যাবেনা। অর্থাৎ একই জায়গায় একাধিক ফার্মিওন থাকলে দেখা যাবে- একটা ঘুমালে আরেকটা ফুটবল খেলছে, একটা খেতে বসেছে তো আরেকটা পাশে দাঁড়িয়ে প্রাতঃকৃত্য সারছে। এদের স্পিন হল ভাঙ্গাচোরা অর্থাৎ ভগ্নাংশ যেমন ১/২, ৩/২ ইত্যাদি। এখন এই বোসনেরা যেহেতু সবাই এক রকম আর ফার্মিওনেরা একেক জন একেক রকম তাই বোসনদের হিসাবপত্র আর ফার্মিওনদের হিসাবপত্রও আলাদা ধরনের। বোসন সংক্রান্ত গোনাগুনতির নাম হল ‘বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’, সব বোসন এই পদ্ধতি মেনে চলে। অথবা উল্টোভাবে বললে যারা এই পরিসংখ্যান মেনে চলে তারাই বোসন। আর ফার্মিওন সংক্রান্ত হিসাব পদ্ধতির নাম ‘ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান’ যার সাথে জড়িয়ে আছে আর এক কিংবদন্তী পদার্থবিদ পল ডিরাকের নাম।
৪।
এই দুই হিসাব সম্পর্কে আর একটু বুঝিয়ে বলি। আবু ইউসুফের কথা মনে আছে তো? [না থাকলে, চরম উদাসের লেখা পড়ে আসেন আগে। পড়া শেষ? ওকে, এইবার শুনেন তাহলে] মনে করেন আবু ইউসুফের কাছে ৩ টা খাঁচা আছে। আর আছে ২ টা বান্দর, একটা সাদা একটা কাল। বান্দর দুইটা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেনা- একজন “গোলামাজমের পুটু চাই” বলে স্লোগান দিলে আরেকজন “তারেকাণু’র ফুটু চাই” বলে গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে, এই অবস্থা। এদেরকে একসাথে রাখলেই হয় পানিপথ নয়তো কুরুক্ষেত্র। এই অবস্থায় একটাই করণীয়- ২ বান্দরকে আলাদা খাঁচায় রাখা। এখন খাঁচা যেহেতু ৩ টা, আবু ইউসুফের বাহিনীর চেহারা হল একরকম (ছবি দ্রষ্টব্য) । আচ্ছা, এবার ধরলাম বন্ধুর বিপদে চরম উদাস যথারীতি এগিয়ে আসলেন। ছাই রঙা ২ টা বান্দর পোষবার ভার তিনি নিলেন। ফ্রি পেলেন ৩ টা খাঁচা। চরম উদাস কাবেল মানুষ। তিনি এসেই আগে ইউএসবি কেবল দিয়ে তাদের ব্রেনে “এসো নিজে করি- কীভাবে নরম মানুষ হবেন” প্রোগ্রামটি ইন্সটল করে দিলেন। ফলাফল ২ বান্দরই ‘বানর-বানর ভাই ভাই/বাঙ্গীর উপরে ফল নাই’ স্লোগান দিয়ে গলাগলি ধরে সুখে শান্তিতে থাকার প্রতিজ্ঞা করল। [ইয়ে... মানে... ক্রিয়েটিভ বান্দর তো, উদাসদার প্রোফাইল পিকচার দেখে স্বজাতি ভেবে তাদের স্রষ্টাকে টানা হ্যাঁচড়া করলে কিন্তু আমার দোষ নাই <img src="http://cdn4.sachalayatan.com/files/smileys/4.gif" title="দেঁতো হাসি" alt="দেঁতো হাসি" class="smiley-content"/> ]। যাহোক, এখন ৩ খাঁচা আর ২ বান্দরের সিস্টেমে উদাস’দার বাহিনীর চেহারা হল আরেকরকম (ছবি দ্রষ্টব্য)। কি বুঝলেন? আবু ইউসুফের ২ বান্দর ৩ খাঁচা, চরম উদাসেরও ২ বান্দর ৩ খাঁচা, অথচ এক যাত্রায় দুজনের ফল হল আলাদা। সবাই মনে হয় এতক্ষনে বুঝে গেছেন, আবু ইউসুফের বান্দরগুলো ফার্মিওন জাতের, আর চরম উদাসের গুলো বোসন।
৫।
বসুর আপাত নিরীহ এই হিসাবপত্রের ফলাফল ছিল ভয়াবহভাবে সুদূরপ্রসারী। জন গ্রিবিন তাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন- “It is no co-incidence that the name ‘Photon’ was coined for the particle of light only in 1926, after Bose had put the quantum theory of light on a secure mathematical footing”। বসুর তত্ত্ব থেকেই পদার্থের পঞ্চম অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, বসু অবশ্য তাঁর এই সাফল্য দেখে যাতে পারেননি। তিনি তাত্ত্বিকভাবে হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, তাপমাত্রা খুব কমিয়ে আনলে ছোটাছুটির শক্তি হারিয়ে পরমাণুরা একেবারে গায়ে গায়ে লেগে বোসনের মত আচরন করে (এমনিতে, একটা পরমাণু কখনও আরেকটার একেবারে ঘাড়ের উপর এসে পড়তে পারেনা, একটা দুরত্বে এসে আটকে যায়)। তখনকার প্রযুক্তিগত বাস্তবতায় সেই অতি নিম্ন তাপমাত্রায় পৌঁছুন সম্ভব হয়নি। তাঁর তাত্ত্বিক রেসিপি মোতাবেক, বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন বা BEC বাস্তবে রাঁধতে বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। প্রক্রিয়াটাও চমৎকার, নাম হল ফুটিয়ে ঠান্ডা করা (Evaporative cooling)। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে চুম্বকের খাচায় পরমানু রাখা হয়। এরপরে, বান্দর টাইপ যেগুলা অর্থাৎ কিনা যাদের শক্তি বেশি তারা যথারীতি খাঁচা থেকে বের হবার জন্য লাফাঁঝাপা শুরু করে। কিন্তু খাচার বাইরে ঘাড়ত্যাড়া বিজ্ঞানীরা ওঁত পেতে বসে থাকেন, মাথা তুললেই খপ! এভাবে বেশি শক্তিশালী পরমাণু গুলোকে ঘাড় ধরে খাঁচা থেকে বের করে দিলে খাঁচার তলায় পড়ে থাকে কম শক্তির শান্তশিষ্ট পরমাণু, আর শক্তি কম মানে তাদের তাপমাত্রাও কম; কারন তাদের ভাগের শক্তি খেয়েই কিন্তু বান্দরটাইপ পরমাণু গুলো পালিয়েছিল। ব্যাস, খাঁচার ভেতর এখন গরমাগরম, থুক্কু অতি-হিমশীতল বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন বা BEC একদম রেডি। এটা একটু হলেও মন খারাপ করার মত ব্যাপার যে, তাঁর রেসিপি রেঁধে অনেকে নোবেল পুরস্কার পেলেও তাঁর ভাগ্যে সে সম্মান জোটেনি, শান্তিতে যেমনটা জোটেনি মহাত্না গান্ধীর। কিন্তু আকর্ষনীয় হলেও নোবেল যে শুধু যে নিছক একটা পুরষ্কার ছাড়া আর কিছু নয় সেটা প্রমান করতেই যেন বসু আজও স্বমহিমায় টিকে আছেন পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে, যেখানে তাঁর সঙ্গী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা, ঢাকা আর সেই সুত্রে পুরো বাংলাদেশ। আচ্ছা, বসু এই বুদ্ধি পেলেন কোথায়? হারুন স্যারের কৌতূহলের জবাবে বসু একবার একগাল হেসে উত্তর দিয়েছিলেন- “আমি যে তোদের ওখানে তাপগতিবিদ্যা পড়াতাম রে!” পড়াতে গিয়েই টের পেলেন যা পড়াচ্ছেন তাতে কি জানি একটা ঘাপলা আছে, এই হলেন সত্যেন বসু। বিনয়ী সত্যেন বসুর জবানীতে অবশ্য- “আমার ধারণাই ছিল না যে আমি যা করেছি তা নতুন কিছু”। বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি অবসরে আইনস্টাইন যেমন বেহালা বাজাতেন, বসু বাজাতেন এস্রাজ। মাতৃভাষার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল তাঁর। তাই অসঙ্কোচে তিনি বলে গিয়েছিলেন- “যারা বলেন যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া যায় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান জানেন না”। এখনকার শিক্ষকেরা কি দয়া করে সত্যেন বসুর পুনর্পাঠ করবেন? সময়ই বোধ হয় ভালো জানে।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন