গত শতকের পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত দুটি বিষয়ের একটি যদি “আপেক্ষিকতা তত্ত্ব” হয়ে থাকে তাহলে আরেকটি নিশ্চিত ভাবেই “কোয়ান্টাম মেকানিক্স”। তবে এ বিষয়গুলো কেন জানি একটু অস্বস্তিকর রকমের ধোঁয়াটেও বটে। আসলে বাস্তব জীবনে আমরা যে ধরনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত, এ দুটো তার চেয়ে একটু বেশিই ভিন্ন মাত্রার। আপেক্ষিক তত্ত্বের দরুন সৃষ্ট, চোখে দেখার মত বড় মাপের পরিবর্তন দেখতে চাইলে আমাদের গতিবেগ হতে হবে আলোর বেগের (৩×১০ টু দ্য পাওয়ার ৮ মিটার/সেকেন্ড) কাছাকাছি। একইভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে কার্যকর দেখতে চাইলে আমাদের যেতে হবে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের (৬.৬৩×১০টু দ্য পাওয়ার মাইনাস ৩৪ জুল-সেকেন্ড) কাছাকাছি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা কখনওই ১০ টু দ্য পাওয়ার ৮ এর উচ্চতায় উঠিনা, আবার ১০টু দ্য পাওয়ার মাইনাস ৩৪ এর গভীরতায়ও নামিনা। বাইরে থেকে এ দুটোই তাই পরিচিত অভিজ্ঞতার সাথে আপাত অসঙ্গতিপূর্ণ দুই প্রহেলিকা’র মত। আসুন পদার্থবিজ্ঞানের ভারী ভারী কোটপ্যান্ট ঝেড়ে ফেলে, সহজ ভাষায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পাড়া থেকে ঘুরে আসি।
(২)
কোয়ান্টা (বহুবচনে কোয়ান্টাম) হল শক্তির প্যাকেট, বা শক্তির টুকরো। ভুরু কুচকে ভাবতে বসে গেছেন? মাছ-মাংসের কিংবা কেকের টুকরোর মত শক্তির আবার টুকরো হয় কি করে! ভাববেন না, ঠিক এই প্রশ্নটাই খোদ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্রষ্টাদেরও তাড়িয়ে বেড়াত বহুদিন। সামগ্রিক ভাবে যাকে আস্ত বলে মনে হয়, তাকে কিন্তু অনেক সময়ই কাছে থেকে দেখলে বা বড় করে দেখলে ক্ষুদ্র অংশেও পৌছুনো যেতে পারে। যেমন বৃষ্টির ধারা দেখলে আস্ত একটা লাইন বলেই মনে হয়, কিন্তু স্লো-মোশনে দেখুন দেখবেন এক এক ফোটা করে পানি পড়ছে, এই একেকটা পানির ফোটাই হল গিয়ে পানির কোয়ান্টা। কিংবা দূর থেকে একটা বালির স্তুপ দেখলে পাহাড়ের মত আস্ত একটা কিছু বলেই মনে হয়, কাছে গিয়ে জুম করে দেখুন- দেখবেন ছোট অনেক গুলো একই রকম বালুকণা জমে বিশাল কিছু হয়েছে। বালুকণা হল বালুর স্তুপের কোয়ান্টা। পানির ধারায় ফোটার চেয়ে ছোট আকৃতি পাবেননা, যেমন পাবেন না বালুর স্তুপে বালুকণার চেয়ে ছোট কিছু। তেমনি শক্তি কেও যদি আমরা স্লো-মোশনে জুম করে দেখতে পারতাম, তবে আশ্চর্য হয়ে দেখতাম যেকোনো শক্তিই আসলে পানির ফোটা কিংবা বালুকণার মত টুকরো টুকরো। তবে এই জিনিসটি গনিতের ফুটোস্কোপ দিয়ে ভেবে বার করেন “ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক”। কোয়ান্টাম মেকানিক্স সংশ্লিষ্ট, সবচেয়ে বহুল ব্যাবহৃত ও বিখ্যাত ধ্রুবকটির নাম তাই তাঁর নামেই রাখা হয়েছে।
(৩)
গত শতকের প্রথম দিকে বাঘা বাঘা তাপ-পদার্থবিজ্ঞানীদের একটা হিসাব কিছুতেই মিলছিল না। বিকিরনের ক্ষেত্রে শক্তির সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘের যে একটা সম্পর্ক আছে সেটা সবাই জানতেন, কিন্তু সেই সম্পর্কটাকে কিছুতেই এক সুতায় গাথা যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা এমন যে, একদল যদি বলতেন যে এদের “লাভ ম্যারেজ” তো আরেক দলের ভাষ্যমতে এদের “এরেঞ্জড ম্যারেজ”। এবং অদ্ভুত ব্যাপার যে- দুই দলই সঠিক ছিলেন ভিন্ন দুই প্রান্তে; অন্তত পরীক্ষন থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি সেই সাক্ষ্যই দিত। এক দলের তত্ত্ব দিয়ে কম তরঙ্গ দৈর্ঘের অংশ টুকু ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল, আরেক দলের তত্ত্ব দিয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘের অংশটুকু। কিন্তু ঐ ছাড়া ছাড়া ভাবে, একবারে নয়। তবে দু’দলই ধরে নিয়েছিলেন শক্তি অবিচ্ছিন্ন, আস্ত। এখানটাতেই ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বাগড়া দিলেন; তিনি হিসেব করে দেখতে গেলেন শক্তির একটা ন্যূনতম একটা মাপ থাকলে কি হত। তারপর সব শক্তিকে এর গুনিতকে প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ তিনি বললেন পানির ফোঁটা বা বালুকণার মত শক্তির ও ন্যূনতম একটা মান আছে। (যদি সেটা “ক” হয় তাহলে দুনিয়ার সব শক্তি ক, ২ক, ৩ক, ১০০ক, ১৯৭১ক, ২০১৩ক, ২১০২১৯৫২ক এমন হবে। কখনোই দেড় ক, আড়াই ক, সাড়ে পঞ্চাশ ক, সোয়া সত্তর ক এমন হবেনা।) ফলাফল অবশেষে দুই তত্ত্ব জোড়া লাগল। দেখা গেলো তারা আসলে প্ল্যাঙ্কের পদ্ধতিরই বিশেষ রূপ; একজন বেশির দিকে, অন্যজন কমের। অধরা হিসেব শেষে মিলল, তবে সেই থেকে শক্তি হয়ে গেল টুকরো টুকরো।
(৪)
কোয়ান্টাম যুগের আগে পদার্থবিজ্ঞান ছিল নিশ্চয়তার হিসাব। বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে বলতে পারতেন যে কার্জন হলের ছাদ থেকে কত বেগে কত কোণ করে ঢিল ছুড়লে ঠিক এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে পড়বে। আকাশের দিকে না তাকিয়েও তারা নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারতেন অমুক দিন অমুক সময়ে সুর্যদেব মুখ লুকোবেন, অমুক দিন চাঁদে ছায়া পড়বে। কিংবা, ঠিক কত বেগে গেলে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে পৌছুনো যাবে। আলো কত দ্রুত ঢাকা থেকে জার্মানী গিয়ে পৌঁছয় এটাও তারা মেপে বার করতে পারতেন। তখন বিজ্ঞানীরা নিপুণভাবে প্রকৃতির মোড়ক খুলে খুলে দেখছিলেন, জানছিলেন। ঠিক এ সময় বিজ্ঞানীরা জানলেন যে প্রকৃতি কখনো কখনো ঘোমটা টানা বধূর মতও আচরন করে। এই প্রথমবার বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন তারা চাইলেই প্রকৃতির সব প্রান্ত খুটিয়ে দেখতে কিংবা জানতে পারবেন না, কিছু জিনিস প্রকৃতি সর্বদা কুয়াশায় ঢেকে রাখবে। এক অংশ ভালভাবে দেখতে গেলে আরেক অংশ অস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। নববধূর মন জয় করার মত প্রকৃতির অনিশ্চয়তার হিসাব ধীরে ধীরে শিখে গেলেন বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে টুকরো শক্তির ধারনার পাশাপাশি “সম্ভাবনা ভিত্তিক” হিসাব পদ্ধতিও কোয়ান্টাম পরিবারের অবিচ্ছেদ্য সদস্য হয়ে উঠল। “নিশ্চয়তা” এর বদলে “সম্ভাবনা” হয়ে উঠল ক্ষুদ্র জগতের মূল আকর্ষণ। আগে বিজ্ঞানীরা চোখ বুজে বলে দিতে পারতেন সোমবার রাত দশটায় বুধ গ্রহকে ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে; বিজ্ঞানীদের সেই নিঁখুত নিশ্চয়তা ছোট্ট একরত্তি ইলেক্ট্রনের কাছে এসে দুর্লভ হয়ে গেল। তবে বিজ্ঞানীরা এটুকু ঠিকই বার করতে পারলেন যে ইলেক্ট্রনকে কোথায় কতখানি পাওয়া যেতে পারে। এ যেন সুকুমার রায়ের “হ-য-ব-র-ল” গল্পের সেই গেছোদাদা; ইলেক্ট্রন কোথায় আছে জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে সে কোথায় কোথায় নেই। কেন নেই, কিভাবে নেই- সে অনেক বড় গল্প, সেটা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।
(৫)
কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে বড় বিজ্ঞানীরাই একটা দ্বিধার মাঝে ছিলেন, তাই আমাদের অস্বস্তিতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আইনস্টাইন তো রাগ করে বলেই ফেলেছিলেন- “ইশ্বর পাশা খেলেন না” (God does not play dice.) এর জবাবে নীলস বোর আবার বলেন- তোমার পরামর্শে ঈশ্বরকে চলতে হবেনা (Don't advice God, what to do.) তবে সবচেয়ে মজার কথাটা বলেন আমুদে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি বলেন “আমি বলতেই পারি যে, কেউই কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝেন না। আমরা আসলে এটা ব্যাবহার করতে পারি”। অনেক পদার্থবিদের হাতে গড়ে ওঠা আজকের কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসলে গনিতের মতই একটা পদ্ধতি। এর পত্তনকারী বিনয়ী প্ল্যাঙ্কের ভাষায়- “যদিও এ পদ্ধতি প্রচন্ড নিখুঁত, তবুও এটা একটা সংযোজনী সুত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। যা কিছুটা ভাগ্যক্রমে আন্দাজ করা গিয়েছে।” তাঁর কথা মিথ্যে নয়, পরমানুর সুগভীর নিচুতলার বর্ণনা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিখুঁতভাবেই দিয়ে চলেছে। ইশ্বর পাশা খেলুন আর নাই খেলুন, প্রকৃতি তাই পরমানুর গভীরে সর্বদা জুয়া খেলে চলেছে, নিঁখুতভাবে। এভাবেই বুঝি প্রকৃতি তার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে বিমুর্ত চিত্রকলা কিংবা আধুনিক কবিতার মত অস্পষ্টতার মিশেল দিয়ে। প্রকৃতির সেই বিমুর্ত চিত্রের ক্যাপশন অথবা আধুনিক কবিতার সারমর্মই কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
(২)
কোয়ান্টা (বহুবচনে কোয়ান্টাম) হল শক্তির প্যাকেট, বা শক্তির টুকরো। ভুরু কুচকে ভাবতে বসে গেছেন? মাছ-মাংসের কিংবা কেকের টুকরোর মত শক্তির আবার টুকরো হয় কি করে! ভাববেন না, ঠিক এই প্রশ্নটাই খোদ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্রষ্টাদেরও তাড়িয়ে বেড়াত বহুদিন। সামগ্রিক ভাবে যাকে আস্ত বলে মনে হয়, তাকে কিন্তু অনেক সময়ই কাছে থেকে দেখলে বা বড় করে দেখলে ক্ষুদ্র অংশেও পৌছুনো যেতে পারে। যেমন বৃষ্টির ধারা দেখলে আস্ত একটা লাইন বলেই মনে হয়, কিন্তু স্লো-মোশনে দেখুন দেখবেন এক এক ফোটা করে পানি পড়ছে, এই একেকটা পানির ফোটাই হল গিয়ে পানির কোয়ান্টা। কিংবা দূর থেকে একটা বালির স্তুপ দেখলে পাহাড়ের মত আস্ত একটা কিছু বলেই মনে হয়, কাছে গিয়ে জুম করে দেখুন- দেখবেন ছোট অনেক গুলো একই রকম বালুকণা জমে বিশাল কিছু হয়েছে। বালুকণা হল বালুর স্তুপের কোয়ান্টা। পানির ধারায় ফোটার চেয়ে ছোট আকৃতি পাবেননা, যেমন পাবেন না বালুর স্তুপে বালুকণার চেয়ে ছোট কিছু। তেমনি শক্তি কেও যদি আমরা স্লো-মোশনে জুম করে দেখতে পারতাম, তবে আশ্চর্য হয়ে দেখতাম যেকোনো শক্তিই আসলে পানির ফোটা কিংবা বালুকণার মত টুকরো টুকরো। তবে এই জিনিসটি গনিতের ফুটোস্কোপ দিয়ে ভেবে বার করেন “ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক”। কোয়ান্টাম মেকানিক্স সংশ্লিষ্ট, সবচেয়ে বহুল ব্যাবহৃত ও বিখ্যাত ধ্রুবকটির নাম তাই তাঁর নামেই রাখা হয়েছে।
(৩)
গত শতকের প্রথম দিকে বাঘা বাঘা তাপ-পদার্থবিজ্ঞানীদের একটা হিসাব কিছুতেই মিলছিল না। বিকিরনের ক্ষেত্রে শক্তির সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘের যে একটা সম্পর্ক আছে সেটা সবাই জানতেন, কিন্তু সেই সম্পর্কটাকে কিছুতেই এক সুতায় গাথা যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা এমন যে, একদল যদি বলতেন যে এদের “লাভ ম্যারেজ” তো আরেক দলের ভাষ্যমতে এদের “এরেঞ্জড ম্যারেজ”। এবং অদ্ভুত ব্যাপার যে- দুই দলই সঠিক ছিলেন ভিন্ন দুই প্রান্তে; অন্তত পরীক্ষন থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি সেই সাক্ষ্যই দিত। এক দলের তত্ত্ব দিয়ে কম তরঙ্গ দৈর্ঘের অংশ টুকু ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল, আরেক দলের তত্ত্ব দিয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘের অংশটুকু। কিন্তু ঐ ছাড়া ছাড়া ভাবে, একবারে নয়। তবে দু’দলই ধরে নিয়েছিলেন শক্তি অবিচ্ছিন্ন, আস্ত। এখানটাতেই ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বাগড়া দিলেন; তিনি হিসেব করে দেখতে গেলেন শক্তির একটা ন্যূনতম একটা মাপ থাকলে কি হত। তারপর সব শক্তিকে এর গুনিতকে প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ তিনি বললেন পানির ফোঁটা বা বালুকণার মত শক্তির ও ন্যূনতম একটা মান আছে। (যদি সেটা “ক” হয় তাহলে দুনিয়ার সব শক্তি ক, ২ক, ৩ক, ১০০ক, ১৯৭১ক, ২০১৩ক, ২১০২১৯৫২ক এমন হবে। কখনোই দেড় ক, আড়াই ক, সাড়ে পঞ্চাশ ক, সোয়া সত্তর ক এমন হবেনা।) ফলাফল অবশেষে দুই তত্ত্ব জোড়া লাগল। দেখা গেলো তারা আসলে প্ল্যাঙ্কের পদ্ধতিরই বিশেষ রূপ; একজন বেশির দিকে, অন্যজন কমের। অধরা হিসেব শেষে মিলল, তবে সেই থেকে শক্তি হয়ে গেল টুকরো টুকরো।
(৪)
কোয়ান্টাম যুগের আগে পদার্থবিজ্ঞান ছিল নিশ্চয়তার হিসাব। বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে বলতে পারতেন যে কার্জন হলের ছাদ থেকে কত বেগে কত কোণ করে ঢিল ছুড়লে ঠিক এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে পড়বে। আকাশের দিকে না তাকিয়েও তারা নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারতেন অমুক দিন অমুক সময়ে সুর্যদেব মুখ লুকোবেন, অমুক দিন চাঁদে ছায়া পড়বে। কিংবা, ঠিক কত বেগে গেলে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে পৌছুনো যাবে। আলো কত দ্রুত ঢাকা থেকে জার্মানী গিয়ে পৌঁছয় এটাও তারা মেপে বার করতে পারতেন। তখন বিজ্ঞানীরা নিপুণভাবে প্রকৃতির মোড়ক খুলে খুলে দেখছিলেন, জানছিলেন। ঠিক এ সময় বিজ্ঞানীরা জানলেন যে প্রকৃতি কখনো কখনো ঘোমটা টানা বধূর মতও আচরন করে। এই প্রথমবার বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন তারা চাইলেই প্রকৃতির সব প্রান্ত খুটিয়ে দেখতে কিংবা জানতে পারবেন না, কিছু জিনিস প্রকৃতি সর্বদা কুয়াশায় ঢেকে রাখবে। এক অংশ ভালভাবে দেখতে গেলে আরেক অংশ অস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। নববধূর মন জয় করার মত প্রকৃতির অনিশ্চয়তার হিসাব ধীরে ধীরে শিখে গেলেন বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে টুকরো শক্তির ধারনার পাশাপাশি “সম্ভাবনা ভিত্তিক” হিসাব পদ্ধতিও কোয়ান্টাম পরিবারের অবিচ্ছেদ্য সদস্য হয়ে উঠল। “নিশ্চয়তা” এর বদলে “সম্ভাবনা” হয়ে উঠল ক্ষুদ্র জগতের মূল আকর্ষণ। আগে বিজ্ঞানীরা চোখ বুজে বলে দিতে পারতেন সোমবার রাত দশটায় বুধ গ্রহকে ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে; বিজ্ঞানীদের সেই নিঁখুত নিশ্চয়তা ছোট্ট একরত্তি ইলেক্ট্রনের কাছে এসে দুর্লভ হয়ে গেল। তবে বিজ্ঞানীরা এটুকু ঠিকই বার করতে পারলেন যে ইলেক্ট্রনকে কোথায় কতখানি পাওয়া যেতে পারে। এ যেন সুকুমার রায়ের “হ-য-ব-র-ল” গল্পের সেই গেছোদাদা; ইলেক্ট্রন কোথায় আছে জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে সে কোথায় কোথায় নেই। কেন নেই, কিভাবে নেই- সে অনেক বড় গল্প, সেটা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।
(৫)
কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে বড় বিজ্ঞানীরাই একটা দ্বিধার মাঝে ছিলেন, তাই আমাদের অস্বস্তিতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আইনস্টাইন তো রাগ করে বলেই ফেলেছিলেন- “ইশ্বর পাশা খেলেন না” (God does not play dice.) এর জবাবে নীলস বোর আবার বলেন- তোমার পরামর্শে ঈশ্বরকে চলতে হবেনা (Don't advice God, what to do.) তবে সবচেয়ে মজার কথাটা বলেন আমুদে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি বলেন “আমি বলতেই পারি যে, কেউই কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝেন না। আমরা আসলে এটা ব্যাবহার করতে পারি”। অনেক পদার্থবিদের হাতে গড়ে ওঠা আজকের কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসলে গনিতের মতই একটা পদ্ধতি। এর পত্তনকারী বিনয়ী প্ল্যাঙ্কের ভাষায়- “যদিও এ পদ্ধতি প্রচন্ড নিখুঁত, তবুও এটা একটা সংযোজনী সুত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। যা কিছুটা ভাগ্যক্রমে আন্দাজ করা গিয়েছে।” তাঁর কথা মিথ্যে নয়, পরমানুর সুগভীর নিচুতলার বর্ণনা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিখুঁতভাবেই দিয়ে চলেছে। ইশ্বর পাশা খেলুন আর নাই খেলুন, প্রকৃতি তাই পরমানুর গভীরে সর্বদা জুয়া খেলে চলেছে, নিঁখুতভাবে। এভাবেই বুঝি প্রকৃতি তার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে বিমুর্ত চিত্রকলা কিংবা আধুনিক কবিতার মত অস্পষ্টতার মিশেল দিয়ে। প্রকৃতির সেই বিমুর্ত চিত্রের ক্যাপশন অথবা আধুনিক কবিতার সারমর্মই কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন