আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন!!

আমরা কোন স্প্যাম পাঠাবোনা। ওয়াদা।

সোমবার, আগস্ট ১৮, ২০১৪

ফার্মা'র শেষ উপপাদ্য




গণিত কাঠখোট্টা, গণিত বিরক্তিকর। কিন্তু সেই গণিতেই আছে কোমল, মায়াময় রহস্য আর টান টান শিহরণ। বলবো একটি ধাঁধার গল্প, ধাঁধাটি সরল আবার কঠিন। ঠিক যেমনটা মানুষের মন। গণিতকে ভালোবেসে মানষ পেয়েছে অমরত্ব, আবার তাকে পায়েও ঠেলেছে নিতান্ত অবহেলায়। এ গল্প তাই কেবল গাণিতিক নয়, মানবিকও।

Pierre_de_Fermat


শুরুটা হয়েছিল এভাবে।

সপ্তদশ শতাব্দীর কোনো এক স্নিগ্ধ ভোরে নিজের পড়ার ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ মোটাসোটা একটি বই পড়ছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের দ্য ফের্মা (Pierre de Fermat)বইটি গণিতের প্রাচীন গ্রীক সংকলন, 'এরিথমেটিকা'

অনেক দিন ধরেই ফের্মা বইটি পড়ছেন। এতে এত চমকপ্রদ সব গাণিতিক সমস্যা আছে যে ফের্মা প্রায় প্রতিদিন আগের চেয়ে দ্বিগণ উতসাহ নিয়ে সেগুলোর সমাধান চিন্তা করেন। প্রতিবার এক একটি সমস্যার সমাধান খুঁজে পান, আর ভাবেন, আহ্ এর চেয়ে সুখ আর কি হতে পারে জীবনে, জগতের সবচেয়ে ধ্রুব সত্য গণিতের সেবা করতে পেরে ফের্মার মন দ্রবীভূত হয়ে যায়। বই থেকে চোখ তুলে প্রতিবার সামনে তাকান, সে চোখে থাকে আনন্দের তৃপ্তি, চিকচিক করে সত্যের প্রতি প্রার্থনার জল। তারপর লিখে রাখেন সদ্য আবিষ্কৃত গণিতের কোনো চিরন্তন প্রমাণ কিংবা কোনো গাণিতিক সমস্যার কথা, যাদের অনেকগুলোই পরবর্তী অজস্র গণিতবিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের এবং আনন্দের কারণ হয়ে থাকবে।

তারপরই প্রতিবার বিষন্নতা ভর করে জগতবিখ্যাত গণিতবিদ পিয়ের দ্য ফের্মার মনে।

এরকমই এক বিষন্ন সকালের একটু একটু করে ফুটে উঠা আলোয় ফের্মা একটি অসাধারণ সুন্দর কিন্তু বিদঘুটে সমস্যা নিয়ে ভাবছিলেন।

ভাবতে ভাবতে একসময় মুচকি হাসলেন ফের্মা। তারপর কলমদানি থেকে চমতকার কারকার্যখচিত একটি কলম তুলে কালির দোয়াতে চুবালেন। অভিজাত ফরাসি কায়দায় দোয়াতে কলমের গায়ে লেগে থাকা অতিরিক্ত কালিটুকু মুছে নিয়ে বইয়ের মারজিনের ফাঁকা অংশটায় লিখলেন,
'এই সমস্যার অসম্ভব সুন্দর একটি প্রমাণ আমার কাছে আছে। কিন্তু এই মার্জিনে সেটি আটবে না।'

গণিতের ইতিহাসে এত বড় ক্রুর রসিকতা বোধহয় আর কেউ করেন নি। কে জানতো পরবর্তী সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফের্মার সেই অসম্ভব সুন্দর প্রমাণের পেছনে সবাইকে ছুটতে হবে!

ফের্মা বইয়ের মার্জিনে যে সমস্যাটার কথা লিখেছিলেন সেটা এত সহজ যে দশ বছরের যে ছেলেটি স্কুলে গণিত শিখে সেও বুঝতে পারবে,কিন্তু তা প্রমাণ করতে বাঘা বাঘা গণিতজ্ঞদের ঘাম ছুটে যাবে। আদতে সেই সময় কারোরই যে প্রমাণটা জানা ছিল না, তা বলাই বাহুল্য।

ফের্মা'র শেষ উপপাদ্য

আমরা সবাই পীথাগোরাসের উপপাদ্যের কথা জানি।
  
দারুণ আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই উপপাদ্য বলে যে অনেক ত্রিভুজই আমরা গড়তে পারবো যাদের প্রতিটি বাহু হবে পূর্ণসংখ্যা। অন্য কথায়, সংখ্যার জগতে এরকম তিনটি সংখ্যার অনেক সুখী পরিবারই পাওয়া যাবে যেখানে কনিষ্ঠ দুই পূর্ণসংখ্যার প্রতিটির বর্গের সমষ্টি তৃতীয়জনের বর্গের সমান। উদাহরণ,

কিন্তু ফের্মা বললেন যে সেটা ঠিক আছে, ঠিক থাকবে যদি আমরা কেবল সংখ্যাগুলোর বর্গ নেই। ঘন কিংবা তার বেশি সূচক নিলে এই নিয়ম ভেঙ্গে পড়বে। তার মানে, আমরা কখনোই এমন তিনটি পূর্ণসংখ্যা পাবো না যারা নিচের সমীকরণটি মেনে চলবে, যদি n এর মান তিন বা তার চেয়ে বেশি হয়!
  
উপপাদ্যটি এত সহজ যে, কারো বুঝতে তেমন কষ্ট হবার কথা নয়, কিন্তু গণিতবিদরা তো কেবল তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন না, তাদের দরকার গণিত দিয়েই প্রমাণ করা যে ফের্মার এই উপপাদ্যটি আদতেই সঠিক।

বিপত্তিটা ঘটলো সেখানেই।

উপপাদ্যটির কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারছিলেন না। আবার কেউ এমন কোনো উদাহরণও দিতে পারছিলেন না যে, ফের্মার উপপাদ্যটি ভুল।

এর মধ্যে আবার স্বয়ং ফের্মার এমন হেয়ালি! আরে বাবা, যদি জানাই থাকে তাহলে বলে ফেললেই হয়, তা না। রহস্য।

ফের্মার জীবিতাবস্থায় বইয়ের মার্জিনে লেখা সেই অবিষ্মরণীয় দুটি লাইন কারো নজরে আসে নি, ফের্মা নিজেও উপপাদ্যটির কোনো প্রমাণ আর দিয়ে যান নি। মূলত ফের্মার মৃত্যর পর তাঁর ছেলে যখন মার্জিনে লেখা নোটগুলো বই আকারে ছাঁপেন, তখনই সবাই রহস্যটির কথা জানতে পারে।


সেই থেকে বাঘা বাঘা পন্ডিত হয়রান,কিন্তু যে লাউ সেই কদু। গণিত হয়ে থাকলো রহস্যময়, তার চেয়েও রহস্যময় ফের্মার সেই উক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত না উনিশশো পচানব্বই সালে এন্ড্রু ওয়াইলস এসে বললেন, আমার মনে হয়, প্রমাণটা আমি পেয়ে গেছি!


লেখকঃ ফারুক হাসান (সচলায়তন)